বিষয়টি এত দিন যতটা না সামরিক ছিল, তার চেয়ে বেশি মনস্তাত্ত্বিক। অনিশ্চয়তা আর যুদ্ধের অশনিসংকেত যেন গ্রাস করেছিল পুরো বিশ্বকে। অবশেষে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর দাবার চাল চেলেছেন। আর তাতেই অস্থির হয়ে উঠেছে পুরো বিশ্ব। বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়ার এই পদক্ষেপের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে বিশ্বের ওপর। এরই মধ্যে তেলের দাম বেড়েছে। বড় পুঁজিবাজার-গুলোয়ও বড় দরপতন ঘটেছে। এদিকে তাইওয়ানের মতো স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলোও পড়েছে উদ্বেগে।
গত সোমবার গভীর রাতে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক দীর্ঘ বক্তব্যে পুতিন ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত দুই অঞ্চল লুহান্স্ক ও ডনেট্স্ককে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছেন। শুধু তা-ই নয়, ওই দুই অঞ্চলে রুশ সেনা পাঠানোর প্রক্রিয়াও তিনি জোরেশোরে এগিয়ে নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
বিবিসি, সিএনএন, গার্ডিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, সোমবার রাতের ভাষণে পুতিন রাশিয়া ও ইউক্রেনের ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটগুলো তুলে ধরেন। এরপর যেন তাঁর কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরতে থাকে।
তিনি বলেন, কিয়েভ ক্রমান্বয়ে পশ্চিমের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। স্পষ্ট ভাষায় পুতিন বলেন, ‘রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। দেশটির পূর্বাঞ্চল প্রাচীন রাশিয়ার অংশ।’ প্রায় একই সময়ে পুতিন একটি আদেশে স্বাক্ষর করেন, যেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনের লুহান্স্ক ও নেটের অঞ্চলকে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব রাশিয়ার পার্লামেন্ট স্টেট দুবার উচ্চকক্ষে অনুমোদন পেয়েছে। এর আগে গত সপ্তাহে প্রস্তাবটি পেস করে স্টেট দুবার নিম্নকক্ষ। সে সময় পুতিন অবশ্য আভাস দিয়েছিলেন, এমন কিছু করার ইচ্ছা তাঁর নেই। কিন্তু এক সপ্তাহের ব্যবধানেই সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন তিনি।
গতকাল যে সময় পুতিন ওই ভাষণ দেন, তার ঘণ্টাখানেক আগেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা পোষণ করেন। ইউক্রেন ইস্যু নিয়ে এই বৈঠক আয়োজনে এরপরই কাজ শুরু করে দেয় মধ্যস্থতাকারী ফ্রান্স।
সিএনএন জানায়, গতকাল আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের সঙ্গে মস্কোয় বৈঠকে পুতিন বলেছেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্বাধীন হওয়া সব দেশকে সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক রাশিয়া। তবে ইউক্রেনের বিষয়টি ভিন্ন। কারণ, দুঃখজনকভাবে এই দেশের ভূখণ্ড তৃতীয় পক্ষ ব্যবহার করছে রাশিয়ার জন্য হুমকি সৃষ্টিতে।’
পুতিনের ঘোষণা আসার পরই জরুরি বৈঠক করেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। এতে রাশিয়ার পদক্ষেপকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি গতকাল রাজধানী কিয়েভে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধ হবে না এবং রাশিয়া থেকে বড় পরিসরে কোনো অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করা হবে না। তবে যদি এমনটা হয়, তাহলে ইউক্রেনও প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।’ তিনি এ সময় রাশিয়াকে আলোচনার আহ্বান জানান।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, তুরস্ক, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ রাশিয়ার পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। বিপরীতে সিরিয়া রাশিয়ার ঘোষিত দুই স্বাধীন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। চীন সব পক্ষকে সহনশীলতা প্রদর্শনের আহ্বান জানালেও নিন্দা জানায়নি।
তবে রাশিয়ার এই পদক্ষেপে সবচেয়ে উদ্বেগে পড়েছে তাইওয়ান। অঞ্চলটির প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র বলেছেন, জাতিসংঘ যে রাশিয়ার পদক্ষেপের সমর্থন দেয়নি, তাকে তাঁর দেশ সমর্থন জানায়। তিনি বলেন, ‘আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন একইভাবে আমাদের দেশের ওপর চীনের সাম্রাজ্যবাদী দাবি প্রত্যাখ্যান করবে।’
জবাবে গতকাল চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বিশ্বে চীন একটাই এবং তাইওয়ান চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
গার্ডিয়ান জানায়, রাশিয়ার ওই পদক্ষেপের পরপরই বিশ্বে তেলের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। অপরিশোধিত তেলের দাম গতকাল সকালেই প্রায় ৪ শতাংশ বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৯৯ মার্কিন ডলারের বেশি হয়েছে। বিশ্বে তেল ও গ্যাসের বড় সরবরাহক দেশ রাশিয়া। ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার পদক্ষেপে বিশ্বে তেল ও গ্যাসের সরবরাহ বিঘ্নিত হবে—এমন আশঙ্কায় দামের এই উল্লম্ফন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, তেলের দর অচিরেই ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়াবে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর আগে এভাবে তেলের দর বেড়েছিল ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত এক মাস ছয় দিনের এক সামরিক অভিযানে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়েছিল রাশিয়া।
এদিকে ইউরোপীয় পুঁজিবাজার গতকাল দিনের শুরুতেই বড় ধাক্কা খেয়েছে। জার্মানি ও ফ্রান্সের পুঁজিবাজারে সূচকের ২ শতাংশ পতন ঘটেছে। যুক্তরাজ্যের পুঁজিবাজারে সূচকের পতন ঘটেছে প্রায় ১ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারেও বড় দরপতন ঘটেছে। এশিয়ায় জামানের নিক্কেইয়ের পতন ঘটেছে প্রায় ২ শতাংশ, কোরিয়ার কসপির দর কমেছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। এদিকে চীনের সাংহাই ও হংকংয়ের পুঁজিবাজারেও সূচকের পতন ঘটেছে। একই অবস্থা অস্ট্রেলিয়ায়ও।
ইউক্রেনের বিষয়ে রাশিয়ার পদক্ষেপের জবাবে এরই মধ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপের তোড়জোড় শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো। পুতিনের ওই ভাষণের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন। এই আদেশে লুহান্স্ক ও ডনেট্স্ক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে মার্কিন কোনো নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রকার লেনদেন বা কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২৭ সদস্য রাষ্ট্রের কাছে নিষেধাজ্ঞার একটি খসড়া উপস্থাপন করেছে। এতে রাজনীতিক, সামরিক কর্মকর্তা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ ২৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি রাশিয়ার ৩৬২ জন আইনপ্রণেতার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে। ওই ৩৬২ জনের মধ্যে ১১ জন ইউক্রেনের লুহান্স্ক ও ডনেট্স্ককে স্বাধীন ঘোষণার প্রস্তাব করেছিলেন। বাকিরা এর পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন পার্লামেন্টে।
বিবিসি জানায়, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন গতকাল ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে জানিয়েছেন, রাশিয়ার পদক্ষেপের জবাবে তাঁর সরকার পাঁচটি রুশ ব্যাংক ও তিন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শুলজ বলেছেন, রাশিয়া তার দেশে জ্বালানি সরবরাহে নর্ড স্ট্রিম-২ নামে যে পাইপলাইন প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, তার অনুমোদন দেবে না তাঁর সরকার।
রাশিয়ার মিত্র হিসেবে পরিচিত চীন এখনো এ বিষয়ে নীরব। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে তারা সব পক্ষকে সহনশীল থাকার পরামর্শ দিয়েছে। তবে গতকাল নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে ইউক্রেন ইস্যু নিয়ে সাংবাদিকদের অনেক প্রশ্নই এড়িয়ে গেছেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র।
তবে পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞাকে রাশিয়া এক অর্থে উড়িয়েই দিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, নিষেধাজ্ঞায় তাঁরা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।