গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর হঠাৎ ইউক্রেন সীমান্তের কাছে রাশিয়ার বেলগোরোদ শহরে এক ঝাঁক রকেট এসে পড়ল। সেই দিনটির বর্ণনা দিতে গিয়ে বেলগোরোদ শহরের ২১ বছর বয়সি একজন সংবাদকর্মী ইউলিয়া বলেন, আমি শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে থাকি। আর সেদিন আমার বাড়ির বাইরে তিন থেকে চারটি গোলা এসে পড়ল। আমি জানি না, সেগুলো শেল বা শার্পেনেল বা অন্যকিছু কি না!
ইউলিয়া বলেন, পার্শ্ববর্তী ভবনগুলো প্রায় ধ্বংসই হয়ে গেল। আমার বসবাসের ভবনটির কোনো কিছু হয়নি। তবে এটা ছিল বেশ ভয়ের এবং অনেক শব্দ হচ্ছিল। সেই মুহূর্তে কেবল একটি কথাই চিন্তা হচ্ছিল, আর তা হলো– এখানেই সব শেষ।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর বেলগোরোদ শহরে বেশ কয়েকবার বোমাবর্ষণ করা হয়। তবে ডিসেম্বরের ঘটনাটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। সেদিন ২৫ জন মারা যায়, যার মধ্যে পাঁচ শিশু ছিল। আর এই হামলার জন্য ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীকে দায়ী করা হয়। সীমান্তবর্তী এই শহরটি হামলার লক্ষ্যবস্তু হওয়ায় ধরে নেওয়া হয় রাশিয়ার ভেতরও যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
এ প্রসঙ্গে ইউলিয়া বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের পর থেকে শহরের পরিবেশ নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হতে শুরু করে। বেলগোরোদ শহরের মানুষ বুঝতে শুরু করল যুদ্ধ কী, আশপাশের এলাকায় কী ঘটছে। শহরটিকে নিজেদের জন্য নিরাপদ মনে করতে পারছিলেন না তারা। জীবনটাই যেন পাল্টে গেল সবার।
ইউলিয়া জানান, শিশুরাও বুঝতে শুরু করল গোলা কী, তারা চিনতে-শিখল বিমান হামলার সময় সাইরেনে কেমন শব্দ হয় অথবা রক্ত বন্ধ করার জন্য ব্যান্ডেজ কীভাবে বাঁধতে হয়।
ইউলিয়া বলেন, এখন আর সিটি কাউন্সিলে গ্রীষ্মের উৎসবে কতটুকু জমিতে টিউলিপ চাষ হবে, তা নিয়ে আলোচনা হয় না। বরং আলোচনা হয় বোমা থেকে বাঁচতে যে আশ্রয়কেন্দ্রটি আছে, তাতে কীভাবে রং করা হবে। আমার মনে হয়, বেলগোরোদ আর আগের অবস্থায় কখনোই ফিরতে পারবে না।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি আগ্রাসন শুরুর সপ্তাহখানেক পর রাশিয়ার অর্থনীতির চিত্র বিবর্ণ হয়ে পড়ে। রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের দামে ধস নামে আর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পালিয়ে যায়। নানা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে দেশের অর্থনীতি।
২০১৪ সালে প্রথম দফায় রাশিয়ার ওপর যে অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তা থেকে বেশ কিছু শিক্ষা নিয়েছিল দেশটি। বিশেষ করে, জাতীয় আর্থিক অবকাঠামো পুনর্গঠনে ও আর্থিক খাতকে নিয়য়ন্ত্রণে আনতে। আর দ্বিতীয় ধাপে যে শিক্ষা রাশিয়া গ্রহণ করে, তার সৃষ্টি কোভিড মহামারির সময়কালের চ্যালেঞ্জ থেকে।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ আর্তেম কোচনেভ বলেন, নিষেধাজ্ঞার পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে নিজেদের তেল রপ্তানির বিষয়ে সমন্বয় করার সুযোগ পায় রাশিয়া, যা যুদ্ধের সময় কাজে লাগে।
নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করে দেয়। এ কারণে দেশটি তেল রপ্তানি শুরু করে চীন ও ভারতে, যা ক্যামেরুনের মতো তৃতীয় দেশে নিবন্ধন করা জাহাজগুলোতে পাঠানো হতো। এর ফলে রাশিয়ার রিজার্ভে যোগ হয় প্রচুর অর্থ। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমে গেলেও তাদের কোনো অসুবিধাই হয়নি। আর এখন দেশটি এই অর্থ খরচ করছে যুদ্ধের পেছনে।
চলমান এই যুদ্ধে ভাড়াটে ওয়াগনার সেনাদের বিদ্রোহ ছাড়া দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে টলানোর মতো কোনো পরিস্থিতিই তৈরি হয়নি। তাই ধারণা করা হচ্ছে, আগামী মার্চে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে পুতিন পঞ্চমবারের মতো ছয় বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। যদি তিনি মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেন, তবে তিনিই হবেন রাশিয়ার সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট।
এতকিছুতেও রাশিয়ার মানুষের জীবন থেমে নেই। দেশটিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কনসার্ট, চলছে বিভিন্ন প্রদর্শনী। ক্রেতারা এখনও বিদেশি পণ্য যেমন কোকাকোলা হাতের নাগালেই পাচ্ছেন। আর এগুলো আসছে তৃতীয় কোনো দেশ, যেমন উজবেকিস্তান হয়ে। কোনো কোনো রুশ নাগরিক আবার তাদের ভবিষ্যতের বিষয়ে আরও বেশি আশাবাদী।