Tuesday , 16 April 2024
শিরোনাম

চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা কি যুদ্ধে রূপ নিতে পারে?

যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সফরের প্রতিক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনগুলোকে অবরোধ করে শক্তি প্রদর্শনে চীন বৃহস্পতিবার তাইওয়ানকে ঘিরে তার সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া শুরু করেছে।

বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় এই মহড়া শুরু হয়। তাইওয়ানের চার দিকে মোট ছয়টি জায়গায় তাজা গোলাবারুদ ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে তিন দিন ধরে চলবে এই সামরিক মহড়া।

বিবিসির সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, যে ছয়টি এলাকায় এই চীনা মহড়া চলবে তার তিনটি পড়েছে তাইওয়ানের উপকুল থেকে ১২ মাইলের সমুদ্রসীমার ভেতরে – এবং এ ব্যাপারটি নজিরবিহীন।

তাইওয়ান বলেছে – এটা হবে তার আকাশ ও সমুদ্রসীমায় চীনের অবরোধ আরোপের শামিল, এবং জাতিসংঘের কনভেনশনের লংঘন।

এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় পেলোসি তাইওয়ান ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই দেশটির স্বঘোষিত আকাশ-প্রতিরক্ষা সীমার ভেতরে ঢুকে পড়েছিল ২৭টি চীনা যুদ্ধবিমান। এর মধ্যে ২২টি চীনা যুদ্ধবিমান তাইওয়ান প্রণালীর মধ্যরেখা অতিক্রম করে।

চীন তাইওয়ানকে তার নিজের অংশ বলে মনে করে, এবং বিভিন্ন সময় তারা ‘প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে হলেও’দ্বীপটিকে পুনর্দখল করার কথা বলেছে। কিন্তু তাইওয়ান নিজেদের একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে মনে করে।

 

‘বড় সংকট তৈরি হতে পারে’

বিবিসির সংবাদদাতা রুপার্ট উইংফিল্ড-হেইস বলছেন, এ মহড়া থেকে একটা বড় সংকট সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।

যদি ১২-মাইল জলসীমার ভেতরে চীনের রণতরী বা বিমান ঢোকে – তাহলে তাইওয়ান একে আগ্রাসন হিসেবে দেখতে পারে এবং ভাবতে পারে যে নিজস্ব জলসীমা রক্ষার জন্য তাকে কিছু একটা করতে হবে।

তিনি জানাচ্ছেন – মার্কিন নৌবাহিনী পরিস্থিতির ওপর সতর্ক নজর রাখছে এবং তাদের বিমানবাহী জাহাজ ইউএসএস রোনাল্ড রিগ্যানের ‘ব্যাটল গ্রুপ’ এখন ফিলিপিন সাগরের একটি কাছাকাছি এলাকার দিকে যাচ্ছে।

অন্যদিকে চীনের বিমানবাহী জাহাজের ব্যাটল গ্রুপটিও তাইওয়ান প্রণালীর দিকে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

 

এ উত্তেজনা কি যুদ্ধে রূপ নিতে পারে?

বিবিসির সংবাদদাতা জশুয়া চিটহ্যাম এ প্রশ্ন করেছিলেন লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের চায়না ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক স্টিভ স্যাং-কে। তিনি বলেন, একেবারে এক্ষুণি যুদ্ধ বেধে যাবার সম্ভাবনা কম।

‘চীনাদের এখনো সেই সক্ষমতা হয়নি যে তারা তাইওয়ান নিয়ে নেবে, আমেরিকানদের মোকাবিলা করবে এবং তারা যে জিতবেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত বোধ করবে, বলেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো মাইকেল ও’হ্যানলন বলেন, সরাসরি যুদ্ধ কারো স্বার্থেরই অনুকুল হবে না।

তবে তিনি বলেন, ‘এরকম কোন যুদ্ধ কোনদিকে মোড় নেবে তা কেউ বলতে পারে না, এটা খুব সহজেই বৈশ্বিক চেহারা নিয়ে নিতে পারে, পারমাণবিক হুমকিও তৈরি হতে পারে’।

ও’হ্যানলন বিবিসিকে বলেন, ‘চীন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি উদ্বেগের কারণ, কিন্তু রাশিয়ার মত গুরুতর হুমকি নয়’।

তার কথা, ভ্লাদিমির পুতিন এটা দেখিয়েছেন যে তিনি তার লক্ষ্য অর্জনে বিরাট ঝুঁকি নিতে পারেন- কিন্তু ‘আমার মনে হয়না তাইওয়ানের ব্যাপারে একান্ত বাধ্য না হলে চীন সেরকম কোন পথ নেবে ’।

 

তাইওয়ান কোথায়?

তাইওয়ান একটি দ্বীপ, দক্ষিণ পূর্ব চীনের উপকূল থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১০০ মাইল। তাইওয়ান তথাকথিত ‘প্রথম সারির দ্বীপপুঞ্জের’ মধ্যে একটি । এই সারিতে রয়েছে আমেরিকার বন্ধুপ্রতিম অঞ্চলগুলো। মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির জন্য এই দ্বীপগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কিছু পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ বলছেন, চীন যদি তাইওয়ানের দখল নিতে পারে তাহলে চীন প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চলে অবাধে তার ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারবে এবং সেটা আরও দূরে গুয়াম ও হাওয়াইতে যে আমেরিকান সামরিক ঘাঁটিগুলো আছে – সেগুলোর জন্য সম্ভাব্য ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।

কিন্তু চীন জোর দিয়ে বলছে তাদের উদ্দেশ্য পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ।

 

তাইওয়ান কি সবসময় চীন থেকে আলাদা ছিল?

ঐতিহাসিক সূত্রগুলো বলছে যে তাইওয়ান প্রথম পুরো চীনের নিয়ন্ত্রণে আসে সতেরশ শতাব্দীতে যখন কিং রাজবংশের শাসনামল শুরু হয়। এরপর ১৮৯৫ সালে প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধে হেরে যাবার পর চীনকে এই দ্বীপটি তুলে দিতে হয় জাপানের হাতে।

এরপর জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাবার পর ১৯৪৫ সালে চীন আবার জাপানের কাছ থেকে দ্বীপটি নিয়ে নেয়।

কিন্তু মূল চীনা ভুখণ্ডে চিয়াং কাই-শেক-এর নেতৃত্বাধীন দেশটির জাতীয়তাবাদী সরকারি বাহিনী এবং মাও-এর কম্যুনিস্ট পার্টির মধ্যে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।

ঐ যুদ্ধে জয়ী হয়ে ১৯৪৯ সালে কম্যুনিস্টরা বেইজিংয়ে ক্ষমতায় বসে।

চিয়াং কাই-শেক এবং তার জাতীয়তাবাদী দলের তখনও যেটুকু অবশিষ্ট ছিল- যারা পরিচিত ছিল কুয়োমিনটাং নামে – তারা পালিয়ে যায় তাইওয়ান দ্বীপে। পরবর্তী বেশ কয়েক দশক তারা ওই দ্বীপ শাসন করে।

চীন এই ইতিহাস উল্লেখ করেই দাবি করে থাকে যে তাইওয়ান শুরু থেকেই চীনের একটি প্রদেশ ছিল। কিন্তু তাইওয়ানিরা আবার একই ইতিহাসের কথা বলে যুক্তি দেখায় যে ১৯১১ সালের বিপ্লবের পর প্রথম যে আধুনিক চীনা রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, অথবা তারও পরে মাওএর অধীনে যে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হয়, তারা কখনই তার কোন অংশ ছিল না।

সেই সময় থেকেই কুয়োমিনটাং ছিল তাইওয়ানের সবচেয়ে পরিচিতি প্রথম সারির রাজনৈতিক দলগুলোর একটি; যারা তাইওয়ানের ইতিহাসের একটা উল্লেখযোগ্য সময় জুড়ে দ্বীপটি শাসন করেছে।

বর্তমানে, মাত্র ১৩টি দেশ এবং ভ্যাটিকান তাইওয়ানকে সার্বভৌম একটি দেশের স্বীকৃতি দেয়। তাইওয়ানকে স্বীকৃতি না দেবার জন্য অথবা স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে এমন ধারণা না দেবার জন্য চীন অন্যান্য দেশের ওপর প্রবল কূটনৈতিক চাপ দিয়ে থাকে।

তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গত ৪০ বছরের মধ্যে এখন সবচেয়ে খারাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

প্রতিরক্ষা সক্ষমতা কার কতখানি?

চীন অসামরিক পথে তাইওয়ানের সাথে ‘পুনরেকত্রীকরণ’ এর চেষ্টা করতে পারে, যেমন অর্থনৈতিক যোগাযোগ সুদৃঢ় করার মাধ্যমে।

তবে সামরিক সংঘাতে জড়ালে তাইওয়ানের সশস্ত্র বাহিনী চীনের সামরিক সক্ষমতার কাছে নগণ্য হয়ে যাবে।

আমেরিকা ছাড়া প্রতিরক্ষা খাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে চীন। নৌবাহিনীর শক্তি থেকে শুরু করে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, বিমান ও সাইবার হামলার সক্ষমতা – সব দিক দিয়েই চীনের শক্তি অনেক বেশি।

চীন তার সামরিক শক্তি ব্যবহার করে থাকে অন্যত্র। কিন্তু সক্রিয় সেনা মোতায়েনের সার্বিক ক্ষমতা দিয়ে বিচার করলে চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে ভারসাম্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ।

 

যদি মুখোমুখি লড়াই শুরু হয়, তাহলে কিছু পশ্চিমা বিশেষজ্ঞের অনুমান যে, তাইওয়ান চীনের হামলার ব্যাপকতা যাতে কম হয় সেজন্য চেষ্টা চালাবে, তারা চেষ্টা করবে চীনের জল ও স্থলে একসঙ্গে হামলা চালাতে সুদক্ষ অ্যাম্ফিবিয়ান বাহিনীর উপকূলে নামা ঠেকাতে, এবং বাইরের দেশগুলো থেকে সাহায্য না আসা পর্যন্ত গেরিলা আক্রমণ চালাতে।

বাইরের সাহায্য আসবে আমেরিকা থেকে, যারা তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে। এ যাবৎ ওয়াশিংটন ‘অস্পষ্ট কৌশল’ এর যে নীতি নিয়েছে, তার অর্থ হল চীন তাইওয়ান আক্রমণ করলে আমেরিকা তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষা দেবে কিনা বা দিলে কীভাবে সেটা দেবে সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্ট রাখা।

কূটনৈতিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ‘এক চীন’ নীতির সমর্থনে অটল রয়েছে, যে নীতি মেনে তারা শুধু বেইজিংএর চীনা সরকারকেই স্বীকৃতি দেয় এবং তাইওয়ানের বদলে চীনের সাথেই আনুষ্ঠানিক যোগাযাগ রাখে।

তবে মে মাসে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দৃশ্যত ওয়াশিংটনের অবস্থান আরও কঠোর করেছেন।

তাইওয়ান আক্রান্ত হলে আমেরিকা তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষা দেবে কিনা এ প্রশ্নে বাইডেনের উত্তর ছিল- ‘হ্যাঁ’। হোয়াইট হাউস জোর দিয়ে বলেছে যে ওয়াশিংটন তার অবস্থান বদলায়নি।

 

পরিস্থিতির কি অবনতি হচ্ছে?

চীন ২০২১ সালে তাইওয়ানের বিমান প্রতিরক্ষা এলাকার ভেতর সামরিক বিমান পাঠিয়ে দ্বীপটির ওপর চাপ কার্যত বাড়িয়েছিল। এটি একটি স্ব-ঘোষিত প্রতিরক্ষা বলয় যার ভেতর বিদেশি বিমান ঢুকলে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে তাকে শনাক্ত করা হয়, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

তাইওয়ান ২০২০ সালে এই সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে। তাদের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে সর্বাধিক সংখ্যক চীনা বিমান সেখানে ঢোকে। ওই মাসে একদিন চীনা বিমান ওই এলাকায় ৫৬বার অনুপ্রবেশ করে।

 

তাইওয়ানের জনগণ কতটা উদ্বিগ্ন?

চীন এবং তাইওয়ানের মধ্যে সম্প্রতি উত্তেজনা বাড়া সত্ত্বেও জরিপ বলছে যে তাইওয়ানের বহু মানুষ এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামাচ্ছে না।

তাইওয়ান পাবলিক ওপিনিয়ন ফাউন্ডেশন ২০২১ সালের অক্টোবরে মানুষের কাছে জানতে চেয়েছিল তারা কি মনে করে – এই উত্তেজনার জেরে শেষ পর্যন্ত চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে যুদ্ধ লাগবে?

তাদের দুই-তৃতীয়াংশের (৬৪.৩%) উত্তর ছিল যে তারা সেটা মনে করে না।

আরেকটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে তাইওয়ানের বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের তাইওয়ানিজ বলে পরিচয় দেয়- যা সম্পূর্ণ আলাদা একটা পরিচিতি।

ন্যাশানাল চেংচি ইউনিভার্সিটির ১৯৯০এর প্রথম দিকের পর থেকে চালানো জরিপে দেখা যাচ্ছে- তাইওয়ানে চীনা অথবা একই সঙ্গে চীনা ও তাইওয়ানিজ বলে পরিচয় দেওয়া মানুষের সংখ্যা কমে গেছে এবং সেখানে বেশির ভাগ মানুষ নিজেদের তাইওয়ানিজ বলে মনে করেন।

 

তাইওয়ান কেন বাকি বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

তাইওয়ানের অর্থনীতির ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। সারা বিশ্বে দৈনন্দিন ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি – ফোন থেকে ল্যাপটপ, ঘড়ি থেকে কম্পিউটর গেমসের কনসোল – সব কিছুই চালায় যে কম্পিউটার চিপস তার সিংহভাগ তৈরি হয় তাইওয়ানে।

একটি হিসাব অনুযায়ী – শুধু একটিমাত্র তাইওয়ানিজ কোম্পানি – তাইওয়ান সেমিকন্ডাকটার ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি বা টিএসএমসি- বিশ্ব বাজারের অর্ধেকের বেশি কম্পিউটার চিপস উৎপাদন করে।

টিএসএমসি একটি ‘উৎপাদন কারখানা’ – এমন একটি প্রতিষ্ঠান যারা ভোক্তা এবং সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিজাইন করা চিপস তৈরি করে। এটি একটি বিশাল শিল্প যার ব্যবসার পরিমাণ ২০২১ সালে ছিল দশ হাজার কোটি ডলার।

চীন যদি তাইওয়ান দখল করে নেয়, তাহলে বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি শিল্প বেইজিং নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

Check Also

‘মোদির গ্যারান্টি’তে বিজেপির ইশতেহার

সামনেই ভারতের লোকসভা নির্বাচন। চলতি মাসের ১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুন পর্যন্ত চলবে ভোটভুটির আয়োজন। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

x