আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি ও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে না। নির্বাচনের পরে আন্দোলন ও অনাস্থা প্রকাশ করে তারা অনির্বাচিত সরকার আনার পরিকল্পনা করছে। আমি বিশ্ববাসীকে কথা দিয়েছি, চ্যালেঞ্জ দিয়েছি— অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করব। সেই চ্যালেঞ্জ আমাদের ওভারকাম করতে হবে। সংসদ নির্বাচনে প্রত্যেক কেন্দ্রে সিসি টিভি ক্যামেরা বসানো হবে।
বৃহস্পতিবার (২২ জুন) সকালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের রুদ্ধদ্বার সভায় মনোনয়ন প্রত্যাশী সকলের উদ্দেশ্যে এ নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত নীতি-নির্ধারণী এ সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ হাসিনা। বৈঠকের পুরো সময় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়। দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সামনে থাকায় দলের উত্থান-পতন নিয়ে নানা স্মৃতিচারণা করেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা। স্মৃতিচারণা করেন এক এগারোর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারবিরোধী অবস্থান সম্পর্কে বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য নয়, আমাকে উৎখাত করাই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য। শেখ হাসিনাকে সরানো সম্ভব হবে না জেনে গেছে তারা। তাই শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি, অর্জন পচাতে চায়। আওয়ামী লীগকে পচাতে চায়।
এসময় শেখ হাসিনা বলেন, আগামী নির্বাচন আগের মত করে হবে এই স্বপ্ন যারা দেখে বসে আছেন তারা মনোনয়ন পাবেন এ আশা করার দরকার নাই। আগের ভোট আর হবে না। মুখ দেখে কাউকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না। বাবা-চাচা বা আত্মীয় স্বজনের রাজনীতি দেখেও মনোনয়ন দেব না আমি। যিনি প্রার্থী হবেন তার রাজনীতি, তার দক্ষতা ও যোগ্যতাই কেবল মনোনয়নের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, আমি জরিপ করছি। যারা টাকা দিয়ে জরিপে নাম আনার ব্যবস্থা করবেন তারাও জেনে রাখেন রিপোর্ট দেখলেই আমি বুঝি, কোনটা টাকা দিয়ে হয়েছে, কোনটা প্রকৃত অবস্থা। তাই আগে এমপি এখনো মনোনয়ন পাবেন এমন চিন্তা বাদ দিন।
দলীয় নেতারা বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এ সভায় আট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা সারা দেশের সাংগঠনিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। এসময় মাদারীপুর জেলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বলেন, মাদারীপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে শাজাহান খান। নিজের পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্যকে পদ দিয়েছেন। ব্যবসায় দিচ্ছেন, চাঁদাবাজি করার অনুমতি দিচ্ছেন। তার অরাজনৈতিক আচরণে কেউ আওয়ামী লীগ করতে পারে না। তাদের পরিবারের লোক কেউ আওয়ামী লীগ করেনি।
এসময় শাজাহান খান তার বক্তব্যে বলেন, আমার বাবা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭৩ সালের পার্লামেন্টের এমএলএ ছিলেন। আমি মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি করার সময় ওই জেলার কেন্দ্রীয় নেতা সবাইকে অবহিত করেছি। নাছিম আপনাকে বলিনি?
উভয়ের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের এক পর্যায়ে বক্তব্য দিতে শুরু করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, নাছিম তোমার পরিবারের কেউ তো তোমার আগে আওয়ামী লীগ করেনি। তুমি কবে থেকে আওয়ামী লীগ করো! আওয়ামী লীগের রাজনীতি তোমার পরিবারে শুরু হয়েছে তোমাকে দিয়েই। এই যে জাহাঙ্গীর কবির নানক, এস এম কামাল হোসেন, বিএম মোজাম্মেল হোসেন এরা তো বিভিন্ন জায়গা ঘুরে উপায় না পেয়ে আমার কাছে এসেছে। নাছিম তুমি এখন যাদের সঙ্গে থাক তারা সবাই বাকশাল করতো। ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পরে গোপালগঞ্জ যাওয়ার সময় শিবচরে যখন আমাকে আটকায় তখন শাজাহান খান লোক পাঠিয়ে তারা নৌকা দিয়ে নদী পার হয়ে এসে আমাকে নিয়ে যায়। শাজাহান খানকে তো আমি নিতে চাইনি, তোমরাই তো অনুরোধ করেছো। এখন প্রতিদিন কেন ক্যাচাল করো? একমাত্র আব্দুর রহমান কখনো আমাকে ছেড়ে যায়নি। সবার সবকিছুই আমার মনে আছে। শাজাহান খান আওয়ামী লীগ না করলেও সবসময়ই আমার পাশে ছিল। শাজাহান ভাই হাসানুল হক ইনুর জাসদ করলেও আমার সঙ্গেই থেকেছে, ইনুর সঙ্গে থাকেনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এমপি অভিযোগ করে নেতার বিরুদ্ধে। অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ বাদ দিয়ে সবাই কাজে নেমে যাও।
এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আমি তো সবাইকে ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছি। এখন জেলা কমিটিতো তোমরাই দিয়ে দাও। প্রেস রিলিজে লেখা থাকে দলীয় সভাপতির নির্দেশক্রমে। আগে তো আমার স্বাক্ষর থাকতো। এখন তো কমিটি ঘোষণার আগে আমার কাছে আর আসে না। এসময় বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সিটি মেয়র খোকন সেরনিয়াবাতকে মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত একমাত্র আমার একা নিতে হয়েছে। পরে দেখা গেল আমার সিদ্ধান্তই ছিল সঠিক।
এসময় দলের অপর সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, আমিও মৌন সমর্থন জানিয়েছি।
এর জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, মনোনয়ন বোর্ডের যে সদস্য প্রকাশ্য সমর্থন না করে মৌন সমর্থন দেয় তাদের তো মনোনয়ন বোর্ড মেম্বার করাও ঠিক হয়নি।
কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে দলীয় সভাপতি বলেন, তোমরা কেন্দ্রীয় নেতা, তোমাদের কাজ তো শুধু দলীয় কার্যালয়ে বসে আড্ডা মারা, গণভবনে এসে ভালোমন্দ খাওয়া নয়। এজন্য তো দলের নেতা বানানো হয়নি তোমাদের। সবাই এলাকায় যাও, নির্বাচনের প্রস্তুতি নাও।
সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করার সময় কোন জেলায় সাংগঠনিক পরিস্থিতি জটিল সেটাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনার সামনে। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের আধিপত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করে রাজনীতি করার ফলে সংগঠণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও অবহিত করেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে।
এসময় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, তৃণমূলের ত্যাগী নেতাদের বাদ দেওয়া যাবে না। ত্যাগী নেতারা ভালো খাবার দেয় না, টাকা দিতে পাওে না বলে সুযোগ করে তাদেও বাদ দিয়ে দাও। ক্ষমতায় থেকে সুবিধাবাদীরা দুঃসময়ে চলে যাবে, তারা একটাও থাকবে না।
কিছু জেলার সংকট সমাধানে আওয়ামী লীগ সভাপতি নিজে তদারকি করবেন বলে সাংগঠণিক সম্পাদকদের জানান।
প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে দেওয়া বক্তব্যে কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, দলকে আরও সুসংগঠিত করে শক্তিশালী কর। নির্বাচনের প্রস্তুতির পূর্বশর্ত দলকে ঐক্যবদ্ধ করা। এসময় আওয়ামী লীগ সরকার যেসকল উন্নয়ন কার্যক্রম শেষ করেছে সেগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। একই সঙ্গে ২০১৪ সালের বিএনপির আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও সৃষ্টি করে দেশে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি করতে চেয়েছিল তা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দুর্নীতি-লুটপাট ও দুঃশাষণ চালিয়েছিল সেগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে।
সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজকের বৈঠকে পুরো আলোচনা ছিল জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে। অতীতে যে কোন কোন জায়গায় যে বা যারা ভোট কাটাকাটি করে নির্বাচিত হয়েছেন, সেই স্বপ্ন আর কেউ দেখবেন না। সেটা আগামী নির্বাচনে হবে না।
শেখ হাসিনার উদ্ধৃতি দিয়ে এ নেতা বলেন, প্রার্থীদের ভোটারদের কাছে যেতে হবে। ভোটারদের দরজায় গিয়ে সরকারের সফলতাগুলো বলতে হবে।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, কে যোগ্য প্রার্থী তা বাছাইয়ে জরিপ চলছে সারা দেশে। আমি কাউকে দয়া করে মনোনয়ন দেব না। আওয়ামী লীগের ভোট ও প্রার্থীর ভোট বিবেচনা করে মনোনয়ন দিব। কেউ মনে করার কোনো কারণ নেই, আপনাদের মুখ দেখে মনোনয়ন দিয়ে দেব আমি। সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনকে পণ্ড করতে আন্দোলনের নাম করে মাঠে নেমেছে। সবাই মিলে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে হবে। আমি জানি এটা মোকাবিলা করাই আমাদের আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট অনুষ্ঠান করে দেখিয়ে দিব আমরা। নির্বাচন পণ্ড করার বিপরীতে আওয়ামী লীগের কাজ হলো সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়া।