শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মিলছে নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ও মাকর্শিটসহ নানা শিক্ষা সনদ। একজন প্রকৌশলীর নেতৃত্বে একটি চক্র এসব জাল সার্টিফিকেট ও মার্কশিটসহ নানা শিক্ষা সনদ তৈরি করতো। আর চক্রটিকে সহযোগিতা করছে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা।
এমন একটি জাল শিক্ষা সনদ তৈরি চক্রের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মেট্রেপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ। পরে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার লালবাগ রামপুরা এলাকায় দুটি বাসায় অভিযান চালিয়ে চক্রের হোতাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান, তার স্ত্রী নুরুন্নাহার মিতু, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ইয়াসিন আলী ও দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির ডিরেক্টর বুলবুল আহমেদ।
প্রথমে রাজধানীর রামপুরা এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে প্রকৌশলী জিয়াউর ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ একাডেমিক সনদ, মার্কশিট, এনভেলপ ও নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের দেয়া তথ্যে শুক্রবার সকালে লালবাগের বড়ঘাট মসজিদ এলাকার কাশ্মিরি গলির একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় বাকি দুইজনকে। ওই বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় জাল সনদ তৈরির যন্ত্রপাতি ও উপকরণ।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, অভিযানকালে তারা দেখতে পান, দুই কক্ষ বিশিষ্ট বাসাটিতে দামি ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার ও এমবস মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকে সংগ্রহ করা খালি মার্কশিট ও সনদ
।
গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, চক্রের হোতা প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান। তিনি বিদেশে উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন। দেশে ফিরে শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন নকল সার্টিফিকেট তৈরিতে। জিয়া মূলত তার অন্যতম একজন সহযোগী ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ইয়াসিন আলীকে দিয়ে এই কাজ করাতেন। আর এই কাজে তাকে সহায়তা করতেন দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির ডিরেক্টর বুলবুল আহমেদ। তারা এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষের কাছে এসব জাল সার্টিফিকেট বিক্রি করেছেন।
গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, চক্রটি বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরবরাহ করা মূলকাগজ দিয়েই মার্কশিট ও সার্টিফিকেট তৈরি করে বিক্রি করতো। এরপর সেগুলো কর্মকর্তাদের মাধ্যমে অনলাইনে অন্তর্ভুক্ত করতো, যাতে অনলাইন ভেরিফিকেশনে সত্যতা পাওয়া যায়।
ডিএমপি’র গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, জিয়া বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। এই জাল সার্টিফিকেট বিক্রি করে তিনি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটও কিনেছেন। ঘটনার তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদে এই তথ্য জানা গেছে। মূলত জিয়া এক একটি সার্ফিফিকেট বিক্রি করতেন তিন লাখ টাকায়। আর সেটি তৈরির জন্য তার খরচ হতো মাত্র ১০০ টাকা। যা সবটাই লাভ ও অবৈধ টাকা। তাদের মধ্যে কেউ ১৪ বছর, কেউ ১২ বছর ধরে এসব কাজ করে আসছিলেন। গ্রেপ্তার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ইয়াসিন আলী বিভিন্ন ছাপাখানা থেকে সব রকমের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সংবলিত অতি সূক্ষ্মভাবে জাল সনদের কাগজ ছাপিয়ে আনতেন। তিনি নিজেও বিভিন্ন গ্রাহকদের জাল সার্টিফিকেট, মার্কশিট, টেস্টিমনিয়াল ও ট্রান্সক্রিপ্ট দিতেন।
তিনি বলেন, অনলাইন বিজ্ঞাপন দিয়ে জাল সার্টিফিকেট বিক্রি করছে বলে আমরা জানতে পারি। তারা সার্টিফিকেট, মার্কশিট, ট্রান্সক্রিপট ও টেস্টিমোনিয়াল বানিয়ে দেয়। যাতে মানুষেরা দেশ বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। তাদের হাতে বানানো এই ভুয়া সার্টিফিকেটগুলো হাজার হাজার মানুষের কাছে চলে গেছে। ফলে তারা আসল সার্টিফিকেটধারীরা এই নকল সার্টিফিকেট কেনা ব্যক্তিদের কাছে প্রতিবন্ধক হচ্ছেন।
তৈরি করে বিক্রি করেছেন। তবে তিনি যেসব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট জাল করেছেন অনেকগুলোর অস্তিত্ব এখন নেই। আবার কোনোটা আছে। এছাড়া বোর্ডের নামেও সার্টিফিকেট তৈরি করতেন তিনি।
ডিবির লালবাগ বিভাগের ডিসি বলছেন, খালি চোখে দেখলে বোঝা যাবে না যে, সার্টিফিকেটগুলো জাল। এগুলোর ছাপ, লেখা, অ্যাম্বুস সব অরিজিনাল মনে হবে। জিয়াউর স্বীকার করেছেন, এই চক্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বোর্ডের কর্মকর্তারা জড়িত। তাদের টাকা দিয়েই তিনি এসব কাজ করতেন। এছাড়া আরও কিছু লোক আছে যারা মোটা অংকে সার্টিফিকেট বিক্রি করেন, তারা তার কাছে এসব সার্টিফিকেট নেন। জিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জড়িত আছেন, তারা কীভাবে কাজ করেছেন- এসব নিয়ে তদন্ত চলছে।
গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, চক্রটি দুই ধরনের সনদ সরবরাহ করত। কোনো রকমের ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন হবে না এমন সার্টিফিকেট, মার্কশিট, টেস্টিমনিয়াল সরবরাহ করতো। আবার দেশে বিদেশে অনলাইনে ভেরিফিকেশন করা যাবে এমন সনদও সরবরাহ করতো। আর যাচাই বাছাইয়ে যেন ধরা না পড়ে সে জন্য চক্রটি তাদের দলে ভিড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ও বোর্ডের বেশ কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের। তারা টাকার বিনিময়ে অনলাইনে জাল সনদের নম্বর সরবরাহ করতেন।
মশিউর রহমান জানান, গেপ্তার নুরুন্নাহার মিতু ছাড়া অন্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলার রেকর্ড পাওয়া গেছে।