পবিত্র মাহে রমজানে মুমিনের জন্য একটি বিশেষ নামাজের বিধান দেয়া হয়েছে। বছরের আর কোনো মাসে এই নামাজ পড়ার বিধান নেই। বিশেষ এই নামাজের নাম ‘তারাবি’। তারাবি আরবি শব্দ ‘তারবিহাতুন’-এর বহুবচন। এর অর্থ হলো- আরাম করা ও বিশ্রাম করা। এই নামাজ ওয়াজিব বা ফরজ নয়। এ নামাজ সুন্নতে মুয়াক্কাদা। এটা স্বতন্ত্র একটি ইবাদত। রমজান মাসে রোজাদারদের কর্তব্য হলো- গুরুত্ব দিয়ে তারাবির নামাজ আদায় করা।
তারাবি নামাজের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে বুখারি ও মুসলিম শরীফে নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন,যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে পুণ্য লাভের আশায় রমজানের রাতে তারাবি নামাজ আদায় করেন, তাঁর অতীতকৃত পাপগুলো ক্ষমা করা হয়।
মাসয়ালা: তারাবির নামাজ প্রাপ্ত বয়স্ক পুরষ-মহিলা সবার ওপর সুন্নতে মোয়াক্কাদা। অসুস্থ ও রুগীর ওপর তারাবি জরুরি নয়, তবে কোনো কষ্ট না হলে তাদেরও পড়া মুস্তাহাব। -রদ্দুল মুহতার: ১/৭৪২
মাসয়ালা: তারাবির নামাজ জামাতে আদায় করা মুস্তাহাব, একাকি আদায় করলেও আদায় হবে। -বাদায়েউস সানায়ে: ১/২৯০
মাসয়ালা: কারও যদি তারাবির জামাত থেকে কিছু রাকাত ছুটে যায় তাহলে বেতরের নামাজের পর তা আদায় করে নেবে।- রদ্দুল মুহতার: ২/৪৪
মাসয়ালা: নাবালেগ হাফেজের পেছনে বালেগ পুরুষ-মহিলা কারও জন্যই ইক্তিদা করা বৈধ নয়। -আল বাহরুর রায়েক: ১/৩৫৯
মাসয়ালা: ফরজ, নফল বা তারাবি যে নামাজেই প্রত্যেক সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ নিঃসন্দেহে পড়া সুন্নত। তবে বিসমিল্লাহ নিঃশব্দে পড়া সুন্নত। তাই তারাবির নামাজেও খতমে কোরআনের সময় প্রত্যেক সূরার শুরুতে নিঃশব্দে পড়া সুন্নত। তবে যেহেতু বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমও কোরআনের একটি আয়াত; তাই মুসল্লিদের খতম পূর্ণ হওয়ার জন্য যেকোনো সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ স্বশব্দে পড়ে নিলে সবার খতম পূর্ণ হয়ে যাবে। প্রতি সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ স্বশব্দে পড়লেও কোনো সমস্যা নেই। উভয়ের ওপর আমল করার অবকাশ আছে। -রদ্দুল মুহতার: ১/৪৯০
মাসয়ালা: ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে নামাজের ভেতর লোকমা (নামাজের কেরাতে কোথাও ইমামের সন্দেহ হলে এবং সামনে অগ্রসর হতে না পারলে মুক্তাদির তাকে সহযোগিতা করা উত্তম। সহযোগিতার পদ্ধতি হলো, মুক্তাদি উচ্চস্বরে শুদ্ধভাবে পাঠ করবেন। এটাকে পরিভাষায় ‘লোকমা দেয়া’ বলে। অনেক সময় কেরাত ছাড়াও উঠা-বসার ক্ষেত্রে কোথাও ইমামের ভুল হলে তাকে সতর্ক করাকেও লোকমা দেয়া বলে। ইসলামে লোকমা দেয়া ও নেয়ার বিধান রয়েছে। যেগুলো জানা ও মেনে চলা অপরিহার্য) দেয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো না করা উচিত এবং ইমাম সাহেবের জন্য লোকমার অপেক্ষা না করে অন্য আয়াত পড়ে নামাজ শেষ করা উচিত। লোকমা দেয়ার সঠিক পদ্ধতি হলো- প্রথমে ইমাম সাহেবকে আয়াত পুনরাবৃত্তির সুযোগ দেয়া। এতদসত্ত্বেও ইমাম সাহেব শুধরে নিতে না পারলে সেক্ষেত্রে মুক্তাদি লোকমা দিলে কোনো ক্ষতি হবে না। তারাবি নামাজে খতমে কোরআনে যদি হাফেজ সাহেব লোকমার অপেক্ষা না করে, তাহলে লোকমা না দিলে কোনো অসুবিধা হবে না। তবে ভুলে যাওয়া আয়াত পরবর্তীতে সূরা ফাতেহার পর পড়ে নিতে হবে। -রদ্দুল মুহতার: ১/৬২৩
তারাবির নামাজে ভুল করলে:
মাসয়ালা: তারাবির নামাজে দ্বিতীয় রাকাতে না বসে দাঁড়িয়ে গেলে তৃতীয় রাকাতে সিজদা করার পূর্বে স্মরণ হলে বসে তাশাহহুদ ও সেজদায়ে সাহু আদায় করলে তেলাওয়াত ও নামাজ শুদ্ধ হয়ে যাবে। যদি তৃতীয় রাকাতে সিজদা করে ফেলে, তবে চতুর্থ রাকাত মিলিয়ে নেবে। এতে শেষের দুই রাকাত তারাবির নামাজ হিসেবে ধর্তব্য হবে এবং শেষ বৈঠক না করার কারণে প্রথম দুই রাকাত তারাবি হিসেবে গণ্য না হওয়ায় তেলাওয়াতসহ পুনরায় পড়তে হবে। -বাদায়েউস সানায়ে: ১/২৮৯
মাসয়ালা: যদি কোনো ব্যক্তি তারাবির নামাজ চার রাকাতের নিয়ত করে শুরু করে এবং ভুলে দুই রাকাতের পর বৈঠক না করে চার রাকাত শেষ করেই বৈঠক করে, তাহলে সে যদি নামাজ শেষে সেজদায়ে সাহু করে থাকে, তবে শুধু শেষের দুই রাকাত তারাবি হিসেবে গণ্য হবে। -আল বাহরুর রায়েক: ২/১১৭
বসে তারাবির নামাজ:
মাসয়ালা: মাটিতে বসে রুকু-সেজদার মাধ্যমে তারাবি নামাজ বৈধ। অনুরূপ তারাবির কেরাতের সময় চেয়ারে বসে রুকু-সেজদা নামাজের নিয়মমাফিক আদায় করলে তাও বৈধ। কিন্তু বিনা ওজরে এরূপ করলে নামাজের পূর্ণ সওয়াব পাবে না, বরং অর্ধেক সওয়াব পাবে। তবে হ্যাঁ, নিয়মমাফিক রুকু সেজদায় সক্ষম ব্যক্তি চেয়ারে বসে ইশারায় রুকু সেজদার মাধ্যমে নামাজ পড়লে নামাজ শুদ্ধ হবে না। -ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/১১৮
তারাবির নামাজের নিয়ত:
নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তাআলা, রকাআতাই সালাতিত তারাবিহ সুন্নাতু রাসুলিল্লাহি তাআলা, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি, আল্লাহু আকবার।
অর্থ: আমি ক্বিবলামুখি হয়ে দু রাকাআত তারাবিহ সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ নামাজের নিয়ত করছি। আল্লাহু আকবার।
তারাবির সালাত দুই রাকআত দুই রাকআত করে যে কোনো সংখ্যক রাকআত পড়া হয়। তারাবির নামাজের রাকআত নির্দিষ্ট করা হয়নি। হানাফি, শাফিয়ি ও হাম্বলি ফিকহের অনুসারীগণ ২০ রাকআত, মালিকি ফিকহের অনুসারীগণ ৩৬ রাকআত এবং আহলে হাদীসরা ৮ রাকআত তারাবি পড়েন।
তারাবী নামাজে প্রত্যেক দুই রাকাত পর সালাম ফিরানোর পর ইসতেগফার পড়তে হয়, দুরুদ পড়তে হয়, আল্লাহর স্মরণে জিকির করতে হয়। আর চার রাকাত হলেও কুরআন হাদিসের দোয়াগুলো পড়া হয়। দোয়াগুলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে পড়া হয়ে থাকে তাই পড়া হয়।
দোয়া:
সুবহানাযিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি, সুবহানাযিল ইয্যাতি, ওয়াল আযমাতি, ওয়াল হাইবাতি, ওয়াল কুদরাতি, ওয়াল কিবরিয়াই, ওয়াল যাবারুত। সুবহানাল মালিকিল হাইয়্যিল্লাজি লাইয়ানামু ওয়ালা ইয়ামুতু আবাদান আবাদা। সুব্বুহুন কুদ্দুছুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালাইকাতি ওয়ার রূহ।
কিন্তু তারাবির যে দোয়াটি বর্তমানে জারি আছে, এই দোয়া কোরআন হাদিস সম্বলিত নয়। জানা যায়, এটি কোনো এক বুজুর্গ ব্যক্তি লিখে প্রচলন করেন। যার অর্থও ভালো বিধায় পড়া হয়ে থাকে। তাছাড়া, তারাবির নামাজের চার রাকাত পরপর মোনাজাত করা হয়ে থাকে।
মোনাজাত:
আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকা জান্নাতা ওয়া নাউজুবিকা মিনান্নারী, ইয়া খালিকাল জান্নাতা ওয়ান্নারী, বিরহতিকা ইয়া আজিজু, ইয়া গাফফারু, ইয়া কারীমু, ইয়া সাত্তারু, ইয়া রাহীমু, ইয়া জাব্বারু, ইয়া খালিকু, ইয়া বার্র। আল্লাহুম্মা আযিরনা মিনান্নার; ইয়া মুযিরু, ইয়া মুযিরু, ইয়া মুযির। বিরহমাতিকা ইয়া আর হামার রাহিমিন।
তারাবির নামাজ নারী-পুরুষ সকলের জন্য সুন্নতে মুয়াক্কাদা। আমাদের দেশে তারাবির নামাজের দুটি পদ্ধতি প্রচলিত। একটি খতম তারাবীহ আর অন্যটি সূরা তারাবীহ।
খতম তারাবির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কুরআন পাঠ করা হয়। খতম তারাবির জন্য কুরআনের হাফিজগণ ইমামতি