জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের দুই শতাধিক এটিএম বুথ মেশিন থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। এ চক্রের মূলহোতাসহ ৮ জন র্যাবের হাতে ধরা পড়ার পরই বেরিয়ে এসেছে টাকা লুটের অভিনব কৌশলের কথা।
র্যাব বলছে, গ্রেপ্তারকৃতরা বুথের লোডিং ট্রেতে টাকা রাখার সময় ১৯টি এক হাজার টাকার নোট অথবা অন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ নোট ইচ্ছা করে জ্যাম করে রাখতো। কোনো গ্রাহক এটিএম বুথে টাকা তোলার জন্য কার্ড প্রবেশ করিয়ে গোপন পিন নম্বর দিয়ে কমান্ড করলে ওই পরিমাণ টাকা ডেলিভারি না হয়ে পার্সবিনে জমা হতো। পরে সেই টাকা সরিয়ে নিতো চক্রের সদস্যরা। চক্রটি প্রতিদিন ৬০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত কৃত্রিম জ্যাম তৈরির পর আটকে রেখে তা আত্মসাৎ করতো। এভাবে এক বছরে (প্রকৃত সময় ৯ মাস) প্রায় ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। শনিবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তাররা হলেন, আব্দুর রহমান বিশ্বাস (৩২), তারেক আজিজ (২৫), তাহমিদ উদ্দিন পাঠান ওরফে সোহান (২৮), রবিউল হাসান (২৭), হাবিবুর রহমান ওরফে ইলিয়াস (৩৬), কামরুল হাসান (৪৩), সুজন মিয়া (৩১) ও আব্দুল কাদের (৪৩)।
অভিযানে উদ্ধার করা হয় দুটি চেকবই, একটি এটিএম কার্ড, চারটি আইডি কার্ড, একটি স্বর্ণের নেকলেস, এক জোড়া বালা, এক জোড়া কানের দুল, একটি আংটি এবং নগদ ৯ লাখ ৪১ হাজার ৫৫৫ টাকা।
রোববার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথের ব্যবস্থাপনা থার্ড পার্টি বা আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে হয়ে থাকে। টাকা লোড, নিরাপত্তা, কারিগরি ত্রুটিসহ নানা বিষয় পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে এসব থার্ড পার্টি।
সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার মঈন বলেন, একটি বেসরকারি ব্যাংকের অডিটে এটিএম বুথের টাকার বেশকিছু গড়মিল দেখা যায়। ফলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ থার্ড পার্টির (একটি সিকিউরিটি এজেন্সির) সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে। পরে নতুন আরেকটি এজেন্সির সঙ্গে চুক্তি করলেও অনিয়ম ও অর্থের গড়মিল বন্ধ হয়নি। অডিটে বিষয়টি আসার পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও নতুন থার্ড পার্টি সিকিউরিটি এজেন্সি গার্ডা শিল্ড র্যাবের শরণাপন্ন হয়।
খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি ও ছায়া তদন্ত শুরু করে র্যাব। ছায়া তদন্তের এক পর্যায়ে র্যাব উদঘাটন করে, থার্ড পার্টি পরিবর্তন হলেও টাকা লোডার ও অন্যান্য কারিগরি দলের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এরা একটি সংঘবদ্ধ চক্র। তারা ২-৩ বছর এক সঙ্গে চাকরি করার সুবাদে পরিচিত হন। একপর্যায়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেন। গ্রেপ্তার আব্দুর রহমান চক্রটির মূলহোতা।
র্যাব মুখপাত্র বলেন, গ্রেপ্তার অন্য সহযোগীরা কন্ট্রোল রুম, লোডিং, কলিং এবং মেইনটেন্যান্সের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তারা ব্যাংকের বুথে টাকা দেয়া ও মনিটরিং কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ঢাকা শহরের ২৩১টি এটিএম বুথ মেশিনে টাকা লোড করে থাকেন তারা।
এই ২৩১টি এটিএম বুথ মেশিনে টাকা লোডের জন্য ১৯ জন লোডার রয়েছেন। যারা প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে অর্থ পৌঁছে থাকেন। এছাড়া টেকনিক্যাল এক্সপার্ট, কারিগরি সংক্রান্ত বিষয়ে বেশ কয়েকজন নিয়োজিত থাকতেন।
র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, গ্রেপ্তাররা বুথের লোডিং ট্রেতে টাকা দেয়ার সময় ১৯টি এক হাজার টাকার নোটের পরপর অথবা অন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ নোট ইচ্ছা করে জ্যাম করে রাখতো। কোনো গ্রাহক এটিএম বুথে টাকা উত্তোলনের জন্য এটিএম কার্ড প্রবেশ করিয়ে গোপন পিন নম্বর দিয়ে কমান্ড করলে ওই পরিমাণ টাকা ডেলিভারি না হয়ে তা পার্সবিনে জমা হতো। পরবর্তীতে সেই টাকা সরিয়ে নিতো চক্রের সদস্যরা। এক্ষেত্রে মেশিনের একটি কৌশল অবলম্বন করে তারা টাকাগুলো আত্মসাৎ করতো।
গ্রেপ্তার আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, তিনি এই চক্রের মূলহোতা। ৩/৪ বছর আগে তিনি জি-৪ সিকিউরিটিতে চাকরি করতেন। আর্থিক অনিয়ম ও টাকা উধাওয়ের কারণে ওই এজেন্সির সঙ্গে ডাচ বাংলা ব্যাংকের চুক্তি বাতিল হয়। এরপর চক্রের মূলহোতা আব্দুর রহমান পুরো চক্রটি নিয়ে নতুন চুক্তিবদ্ধ গার্ডা শিল্ড সিকিউরিটিজ এজেন্সিতে চাকরি নেন। তার দায়িত্বপূর্ণ এলাকা মিরপুর, কালশী, বেনারসি পল্লি, সেনপাড়া, ইব্রাহিমপুর ও কচুক্ষেত এলাকা। তিনি প্রতিদিন ওইসব এলাকার বিভিন্ন এটিএম বুথে কৃত্রিম জ্যাম সৃষ্টির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করে আসছিলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, চক্রটির সবাই শিক্ষিত। তবে বেতন পেতেন ১৪ থেকে ২০ হাজার টাকা। কিন্তু তারা আত্মসাৎ করা টাকায় বিলাসী জীবন যাপন করতেন।
গ্রেপ্তার আব্দুর রহমান, সোহাগ পাঠান, হাবিব ও কামরুল এটিএম বুথে লোডিং, কলিং ও মেনটেইনেন্সের কাজ করতেন। গ্রেপ্তার কাদের, সুজন, রবিউল ও তারেক আজিজ এটিএম বুথে শুধু লোডিংয়ের কাজ করতেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছে র্যাব।
চক্রটি প্রতিদিন ৬০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত কৃত্রিম জ্যাম তৈরির পর আটকে রেখে আত্মসাৎ করতো। এভাবে এক বছরে (প্রকৃত সময় ৯ মাস) প্রায় ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে দাবি করেছে।