বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন রূপে প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্ব ও অঞ্চলিক কূটনৈতিক রাজনীতিতে এই নির্বাচন উত্তাপ ছড়িয়েছে। যার ফল স্বরূপ, নির্বাচনের পরদিন ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতেরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। আবার অনেক দেশের রাষ্ট্রদূতেরা নীরব ভূমিকা পালন করে। এছাড়া আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতির মাধ্যমে ফুটে ওঠে ভৌগলিক রাজনীতির নতুন মেরুকরণের চিত্র।
বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের পর এই নতুন মেরুকরণের চিত্রটিকে নিয়ে বিবিসি সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বিবিসি উল্লেখ করে, নির্বাচনের পরদিন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানায়। তবে সেটি অনেকের কাছে বেশ ‘অপ্রত্যাশিত’ ছিল। ভারত, চীন ও রাশিয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাবে এটা প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে পশ্চিমাদের পাশ কাটিয়ে জাপান যে অবস্থান নিয়েছে সেটি নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র জাপানের এমন প্রতিক্রিয়ার কারণ নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।
প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, এতো দ্রুত জাপানের অবস্থান বদলে গেল কেন? এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? বাংলাদেশ নিয়ে জাপানের দৃষ্টিভঙ্গিও কি ভারত, রাশিয়া ও চীনের মতো হয়েছে?
জাপানের এই অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিবিসি তার প্রতিবেদনে বলেছে, কূটনীতিতে সব দেশই নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। আর জাপান নির্বাচন প্রক্রিয়াটাকে গ্রহণ করেছে ইতিবাচকভাবে বলে জানিয়ে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘প্রত্যেক দেশ তার নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ এবং আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক অগ্রাধিকারের আলোকেই বাংলাদেশেকে তাদের পররাষ্ট্র নীতির অংশীদার হিসেবে চিন্তা করে। চীন-জাপান তার ব্যতিক্রম নয়। দুই দেশেরই দৃষ্টিভঙ্গিটা মূলত অর্থনীতি কেন্দ্রিক। কারণ তারা জানে এখানে বিনিয়োগের একটা বড় সুযোগ আছে। সেই সুযোগটা তারা কাজে লাগাতে চায়’।
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে কিন্তু খানিকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গা এখানে হয়েছে। বড় বড় প্রজেক্টগুলো যদি দেখেন এক্সপ্রেসওয়ে করেছে চাইনিজরা, মেট্রোরেল করেছে জাপানিরা, পদ্মাসেতু করেছে চাইনিজরা। লক্ষ্য করবেন, আমাদের যে প্রয়োজন আমাদের যে চাহিদা সেই প্রয়োজনের যোগান দেয়ার মতো একটা কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিন্তু আছে। চীনারা যখন এই ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, জাপান কিন্তু তার জাতীয় স্বার্থের আলোকে সেখানে পিছিয়ে থাকতে চায়নি। সেক্ষেত্রে তারা এমন কোনও রাজনৈতিক অবস্থানে যেতে চায় না যে অবস্থানে গেলে তার অর্থনৈতিক স্বার্থটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে’।
তার মতে, জাপানকে পশ্চিমা জগতের সহযোগী হিসেবে না দেখে চীন এবং জাপানকে পাশাপাশি দেখলে বুঝতে সুবিধা হবে কেন জাপান পশ্চিমা জগত থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব অবস্থান নিলো।
ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব নিয়ে সরকারবিরোধী দলগুলো থেকে শুরু বিশ্বের অনেক দেশই বাঁকা সুরে কথা বলে থাকে। অনেকে অভিযোগ করেন, বর্তমান সরকারের পেছন থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কল নাড়ছে ভারত। বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে জাপানের এমন দৃষ্টিভঙ্গি পেছনে ভারতের ভূমিকা কতটুতু?
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নয়নে, বিশেষতঃ দ্বিপাক্ষিক আর্থিক সাহায্যের ক্ষেত্রে জাপান বরাবরই সবচেয়ে বড় সহযোগী ছিলো। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ নামে কয়েকশ কোটি ডলারের চীনা উদ্যোগ এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অংশের মতো বাংলাদেশেও চীনের উপস্থিতিকে আরও দৃশ্যমান করে তোলে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে চীনের করা ওই উদ্যোগের বিকল্প দাঁড় করানোর একটা প্রচেষ্টা ভারত ও জাপানের মধ্যে লক্ষণীয়। সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকা জুড়ে অবকাঠামো প্রকল্প গড়ে তুলছে দেশ দু’টি।
বাংলাদেশে এ মূহুর্তে তিনশ’র বেশি জাপানি কোম্পানি কাজ করছে। দেশটির জন্য গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলও। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প।
দক্ষিন এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতে চীনের আধিপত্য ঠেকানোর আয়োজন?- এমন প্রশ্নকে সামনে এসে বিবিসি তার প্রতিবেদনে বলেছে, কক্সবাজার উপকূলে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা ছিলো বাংলাদেশের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে চীনে গিয়ে বন্দর নির্মাণে দেশটির সাহায্য চেয়েছিলেন। চীন বেশ আগ্রহের সঙ্গেই এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছিল। স্থান নির্ধারণ করা হয় মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়ায়।
কিন্তু তখন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং ভারত সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করে এই পরিকল্পনা বাদ দিতে। তারা উল্টো প্রস্তাব দেয় সোনাদিয়া হতে অল্প দূরত্বে মাতারবাড়িতে জাপানের সহায়তায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য। বাংলাদেশ ২০১৪ সালে শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তই গ্রহণ করে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেয়ারব্যাংক সেন্টার ফর চাইনিজ স্টাডিজের গবেষণা সহযোগী অনু আনোয়ার বলেন, ভারতের বিরোধিতার কারণে সোনাদিয়ায় বন্দর নির্মাণে চীনের সাথে চুক্তির পরিকল্পনা সফল হয়নি। কিন্তু চীন যা দিতে পারে সেটি দেয়ার সক্ষমতা ভারতের নেই। সে কারণে জাপানকে স্বাগত জানানো।
তিনি আরও বলেন, জাপানের অর্থায়নে সোনাদিয়ার অদূরে মহেশখালীরই মাতারবাড়ীতে হচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর। এখন এই বন্দরে বাংলাদেশের যেমন লাভ হবে তেমনি ভারতেরও কম লাভ হবে না।
কিন্তু নয়া দিল্লির রিসার্চ অ্যান্ড ইফরমেশন সিস্টেমে ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজ এর অধ্যাপক প্রবীর দে এ ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তার বিশ্লেষণ, বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক ‘অর্গানিক’। তৃতীয় কোন দেশের এতে প্রভাব নেই। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে। তবে, দূর প্রাচ্যের দেশটির সঙ্গে প্রতিবেশীর সম্পর্কের গভীরতা ভারতের বোঝাপড়ায়ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন তিনি।
তিনটি দেশের অভিন্ন সম্ভাবনাগুলোকে এখনো পুরোপুরি ব্যবহারই করা যায়নি বলে মনে করেন অধ্যাপক প্রবীর।
প্রতিবেদনে প্রবীর দে আরও জানান, বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর আধিপত্য বিস্তারের হিসাব-নিকাশের মধ্যে বাংলাদেশকে সাথে নিয়ে আলোচ্য দুই দেশের আঞ্চলিক অবস্থান দৃঢ় করার প্রবণতা রয়েছে। তার ভাষায়, ‘এটা একটা ভালো প্রভাব বলয় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের যে কৌশলগত অবস্থান ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে তার গুরুত্ব অপরিসীম। আর, ভৌগোলিক অবস্থান তো অপরিবর্তনীয়। এর সঙ্গে ভারত এবং জাপান যুক্ত হলে তাদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়।’ এর ফলে, শক্তিধর দেশগুলোর পক্ষ থেকে কোন কিছু আগের মত চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হবে না বলে মনে করেন মি. প্রবীর।
আর, সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও বৃহত্তর ইন্দো প্যাসিফিক কৌশলকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই অঞ্চলে তাদের নীতি প্রয়োগ করতে হবে। জাপান ও ভারত এই কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। পদ্মাসেতু তৈরি করেছে চীন। জাপানও চায় বাংলাদেশে নানা বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে।’
বৈরিতার মধ্যেও সাদৃশ্য যেখানে বলে মন্তব্য করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত, চীন, জাপানের প্রতিনিধিদের অভিনন্দন জানানোর ক্ষেত্রে সাদৃশ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের নির্বাচন ও নতুন সরকারের ব্যাপারে তাদের সবার অবস্থানই ইতিবাচক। প্রবীর দে’র মতে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত সুদৃঢ়। অর্থনৈতিক দিক থেকে সরাসরি সম্পৃক্ততা, সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য এই সম্পর্কগুলোকে আরও গভীর করেছে। তাই এর মধ্যে চীন ঢুকে পড়লে কিছু নড়াচড়া হয়তো হবে কিন্তু সম্পর্কটা ভেঙে পড়বে না বলে মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক প্রবীর আরও করেন, ভূ-রাজনৈতিকভাবে ভারত এবং জাপান একে অপরের পরিপূরক। অভিন্ন স্বার্থগুলোর ক্ষেত্রে চীনের সাথে তাদের সহাবস্থান বজায় রাখাটা খুব একটা ‘চ্যালেঞ্জিং’ নয়। আবার ভূ-অর্থনীতিতে চীনের সাথে দেশ দুটির বরং সহযোগিতার প্রবণতাই দেখা যায় বলে তিনি মনে করেন। উদাহরণ হিসেবে দেখাচ্ছেন, দিল্লিতে মেট্রোরেল নির্মাণে জাপানি প্রকল্পে চীনের অর্থায়নের বিষয়টিকে। এসবের পরেও নিরাপত্তা ইস্যুতে কিছুটা দূরত্ব অবধারিতভাবে থেকেই যায় বলে উল্লেখ করেন তিনি।