যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস অবশেষে পদত্যাগ করেছেন। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার দুপুরে ডাউনিং স্ট্রিট থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি।
তিনি বলেন যে, তিনি যে জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তা তিনি দিতে পারেননি। তাই তিনি পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মাত্র ৪৫ দিন তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদে ছিলেন। যা ব্রিটেনের ইতিহাসে নজিরবিহীন। ব্রিটেনের সবচেয়ে স্বল্প সময়ের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখালেন তিনি।
লিজ ট্রাস বলেন, তিনি এক ‘ব্যাপক অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক অস্থিরতা’র সময়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। যে কারণে তিনি তার দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করতে পারেননি।
তিনি বলেন, ‘আমি এক ব্যাপক অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক অস্থিরতার সময়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছি। ব্রিটেনের পরিবারগুলো এবং ব্যবসায়ীরা তাদের বিল কীভাবে পরিশোধ করবেন তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। ইউক্রেনে পুতিনের অবৈধ যুদ্ধ আমাদের সমগ্র মহাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। এবং নিম্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশ অনেক দিন ধরে পিছিয়ে আছে। আমাকে নির্বাচিত করা হয়েছিল সেই অবস্থা বদলানোর জন্য। কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি। তাই আমি পদত্যাগ করছি’।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার ছয় সপ্তাহের মধ্যেই কর্তৃত্বের মুঠো আলগা হতে হতে ঘূর্ণিপাকের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন লিজ ট্রাস। বুধবার তার মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় আরেক শীর্ষ মন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদত্যাগ করার একদিন পর বৃহস্পতিবার তার দলের এমপিদের মধ্যেও ঐক্য ও শৃঙ্খলার নাটকীয় ভাঙ্গনের মুখে ক্ষমতা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি।
লিজ ট্রাসের সমস্যা শুরু হয় গত ২৩ সেপ্টেম্বর তার সরকারের প্রথম অর্থমন্ত্রী কাওয়াসি কোয়ার্তেং সংক্ষিপ্ত বাজেট উপস্থাপন করার পর। ওই বাজেটে কর কমানোর ঘোষণা দিলে যুক্তরাজ্যের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। কমে যায় ব্রিটিশ পাউন্ডের দাম। এরপর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে কাওয়াসি কোয়ার্তেংকে সরিয়ে দিয়েছিলেন লিজ ট্রাস। তবে তারপরেও তার পদত্যাগের দাবি তুলতে থাকেন কনজারভেটিভ পার্টির নেতারা।
বৃহস্পতিবার সকালেই এক ডজনেরও বেশি টোরি এমপি প্রকাশ্যে তাকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানান। আর এই এমপিদের সংখ্যা ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেড়ে চলেছিল। তাই অবশেষে তিনি পদত্যাগের ঘোষণাই দিলেন।
দেশটির ইতিহাসে এর আগে সবচেয়ে কম সময় অর্থাৎ মাত্র ১১৯ দিন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন জর্জ ক্যানিং। ১৮২৭ সালে তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ব্রিটেনের স্বল্প সময় প্রধানমন্ত্রী থাকার রেকর্ড ছিল তার। কিন্তু পদত্যাগ করায় এখন ব্রিটেনের সবচেয়ে কম সময় প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার রেকর্ড গড়লেন লিজ ট্রাস।
করোনা বিধিনিষেধের মধ্যে বাসায় পার্টি করাসহ নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন বরিস জনসন। বরিসের সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যদের ভোটে দলীয় নেতা নির্বাচিত হন। গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন তিনি। তার ৪৫ দিনের মাথায় দিলেন পদত্যাগের ঘোষণা।
অর্থনৈতিক সংকটে দিশেহারা যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক সংকট যেন কাটছেই না। নিজ দলের ভেতর চরম আস্থাহীনতার কারণে গত জুলাইয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন বরিস জনসন।
দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা এবং গভীরভাবে বিভক্ত কনজারভেটিভ পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৬ সেপ্টেম্বর জনসনের স্থলাভিষিক্ত হন ট্রাস। তিনি মূলত কর হার সর্বোচ্চ কমানো এবং জ্বালানির খরচে নাভিশ্বাস ওঠা জনগণকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দলের সদস্যদের ভোট জিতেছিলেন।
কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রচণ্ড চাপের মুখে তাকে তার সেই প্রতিশ্রুতি থেকে অপমানজনকভাবে সরে আসতে হয়। গত ২৩ সেপ্টেম্বর ট্রাস ও তার ওই সময়ের অর্থমন্ত্রী কোয়াসি কোয়াটেং একটি নতুন ‘উন্নয়ন পরিকল্পনা’ ঘোষণা করেছিলেন। যাতে ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ কর ছাড়ের পাশাপাশি জাতীয় বিমা পরিকল্পনা ও স্ট্যাম্প শুল্কেও ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ব্যাপক সরকারি ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা এই পরিকল্পনা স্থবির অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবে বলে তারা আশাবাদ প্রকাশ করেছিলেন।
কিন্তু পরিকল্পনাটি সরকারের ব্যাপারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করে, পাউন্ডের মান এবং সরকারি বন্ডের মূল্য কমিয়ে দেয়। এটি বিশ্ব বাজারকে এমন মাত্রায় ধাক্কা দেয় যে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বাজারকে চাঙ্গা করার জন্য ৬৫ বিলিয়ন পাউন্ডের (৭৩ বিলিয়ন ডলার) একটি কর্মসূচী নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়।
যা নিয়ে বাড়তে থাকা রাজনৈতিক চাপ সামাল দিতে ১৪ অক্টোবর কোয়াটেংকে বরখাস্ত করেন ট্রাস। এরইমধ্যে ট্রাসের বিরুদ্ধে দলীয় এমপিদের বিদ্রোহের গুঞ্জন শোনা যেতে শুরু করে। বুধবার ট্রাসের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রাভারম্যানের পদত্যাগ সরকারের ভেতরের চরম বিশৃঙ্খলার নগ্ন চিত্র সামনে নিয়ে আসে। বৃহস্পতিবার দলীয় বেশ কয়েকজন এমপি ট্রাসকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানান।