কোনো বিদেশি সংস্থার প্রেসক্রিপশনে দেশ চলবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, দুয়েকটা বিদেশি সংস্থা কী বললো তা না শুনে দেশ ও জনগণের জন্য যা ভালো তাই করবো। এ সময় তিনি অভিযোগ করেন, অতীতের সরকারগুলো বিদেশি সংস্থার পরামর্শে দেশ চালাতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ দেশ চালাচ্ছে নিজস্ব পরিকল্পনায়।
সোমবার (১৪ মার্চ) সন্ধ্যায় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দীপক স্লোগান ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা উপলক্ষে আয়োজিত ‘জয় বাংলা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় গণভবন থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি।
অনুষ্ঠানের শেষাংশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আমাদের মুক্তির স্লোগান, আমাদের সংগ্রামের স্লোগান। জয় বাংলা স্লোগান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। জয় বাংলা স্লোগানের মধ্য দিয়ে আমরা বিজয় অর্জন করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জয় বাংলা স্লোগান দেওয়ায় ১৯৭১ সালে অনেক মুক্তিকামী মানুষকে পাকিস্তানি হানাদাররা হত্যা করেছে। তবে সে মানুষগুলো জয় বাংলা স্লোগান দিয়েই নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ সুগম করে গেছেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেই স্লোগান আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে এত শক্তি দিয়েছিল যে, তারা শত্রুকে মোকাবেলা করতে এক সেকেন্ডও দ্বিধা করেনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন এখানে গণহত্যা চালাচ্ছে, নির্যাতন চালাচ্ছে, যখন মুক্তিযোদ্ধারা ধরা পড়েছে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের কেউ ধরা পড়েছে, তাদের উপরে নির্যাতন হয়েছে এই জয় বাংলা স্লোগান যেন না দেয়, বারবার নির্যাতন করেছে। কিন্তু তারা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে, বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে আমাদের বিজয়ের পথ সৃষ্টি করে দিয়ে গেছেন।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, বিজয় অর্জন করার পর যে স্লোগান আমাদের অনুপ্রেরণা দিল, সেটাই আর কারো কাছে থাকল না। এটা কোনো কথা হলো? সেটাই আমরা দেখেছি ১৯৭৫ সালের পর।’
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণে জাতির পিতা সম্পূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। গেরিলা যুদ্ধ করার দিকনির্দেশনা যেমন ছিল, তেমনি স্বাধীনতার কথা বলে গেছেন। অপরদিকে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের কথা বলে গেছেন। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ‘জয় বাংলা’ বলে তিনি ভাষণ শেষ করেছিলেন। যে বাঙালির জয় হবে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। তার এই দূরদর্শিতা ছিল আমাদের সকল অর্জনের মূল শক্তি এবং তিনি সেটাই করে গেছেন। বারবার বাধা, বারবার কারাবরণ করেছেন, তাকে ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। পাকিস্তানিরা রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দিয়ে ফাঁসির আদেশ পর্যন্ত দিয়েছিল।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জানি না পৃথিবীর কোনো দেশে এমন আছে কি না স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মধ্যে একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলে। সেটিকে তিনি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে উন্নীত করে রেখে যান। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সময় যেমন অপপ্রচার স্বাধীনতা অর্জনের পরেও সেটা থেমে থাকেনি। অর্থাৎ স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্ত সবসময়ই ছিল। অনেক ষড়যন্ত্র করেও তারা মানুষের হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধু নাম বুঝতে পারেনি। তখনই কিন্তু চরম আঘাত এলো।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৫ আগস্ট, সেদিন শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করেনি। সারাটা জীবন পাশে থেকে সহযোগিতা করেছিলেন আমার মা, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমার ছোটভাই কামাল মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা আরেক ছোট ভাই শেখ জামাল, তাদের দুই স্ত্রী, আমার চাচা কাউকে রেহাই দেয়নি। আমাদের পরিবারের ১৮ জন সদস্য এবং কাজের লোকজনসহ সবাইকে হত্যা করে। এই হত্যার পর থেকেই এই স্লোগান (জয় বাংলা) যা দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার চেতনায়, প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা শত্রুর মোকাবেলা করতেন, যে স্লোগান এদেশের মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল, একটা গেরিলাযুদ্ধ যখন হয় শুধু রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে করে নয়, দেশের অভ্যন্তরে থেকেও যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। আর সেই জয় বাংলা স্লোগান পঁচাত্তরের পর নিষিদ্ধ হয়ে গেল।’
যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে তারা এই স্লোগানকে ধরে রেখেছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাস করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাসী, তারা এটাকে ধরে রেখেছিল। একটি সময়ে নানা ধরনের সমালোচনা শুনতে হয়েছে। তারপরেও আমরা যে সত্যটাকে ধরে রাখতে পেয়েছিলাম বলেই আজকে এটা জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আপনাদের ধন্যবাদ জানাই, আপনাদের মধ্য দিয়ে আমরা এটাই মানুষের কাছে পৌঁছাতে চাই- আমরা বিজয়ী জাতি, আমরা বিজয় অর্জন করেছি। মাথা নত করে আমরা চলি না। মাথা নত করে চলবো না। প্রতিটি বাঙালি যেখানে থাকে নিজের মাথা উঁচু করে বিশ্ব দরবারে তারা চলবে।’
২১০০ সাল পর্যন্ত দেশের অর্থনীতিসহ বিভিন্ন উন্নয়নের দিকনির্দেশনা তৈরি হয়েছে। সে অনুযায়ী দেশ এগিয়ে যাবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনাদের সবার সহযোগিতায় দেশটাকে সামনের পরিকল্পনা অনুসারে এগিয়ে নিতে পরিকল্পনা তৈরি করে দিয়ে গেছি।’
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এমপি বলেন, ‘২০১৯ সালের ৯ মার্চ জাতীয় সংসদে আমার প্রথম বক্তৃতায় প্রস্তাব করেছিলাম, জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান করার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাই, ইতিমধ্যে এটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছে এবং গেজেটও হয়ে গেছে।’
আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করবে এমন প্রত্যাশা জানিয়ে সালমান এফ রহমান বলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশটাকে সোনার বাংলায় পরিণত করার জন্য আপনি (শেখ হাসিনা) আমাদেরকে এই পথে নিয়ে যাচ্ছেন এবং আপনি আবার ইনশাল্লাহ্ আগামী ইলেকশনে জয়ী হবেন। আপনি আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং ইনশাল্লাহ আপনি সোনার বাংলা গড়ার যে যাত্রা শুরু করেছেন এটা কিন্তু আপনি কমপ্লিট করতে পারবেন।’