ই এম আকাশ :
আজ ১৩ অক্টোবর, ২০২২ (বৃহস্পতিবার) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, মিল্টন হলে বিশ্ব হসপিস ও প্যালিয়েটিভ কেয়ার দিবস উদযাপন করলো। বিশ্বব্যাপী নিরাময় অযোগ্য মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ ও তাদের ভুক্তভোগী পরিবারের জন্য সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ এক হয়ে প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শনিবার এই দিনটি উদযাপন করে থাকে। প্যালিয়েটিভ কেয়ার সম্পর্কে প্রচারণা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিস্তার ঘটানোই এই দিবসটির মূল লক্ষ্য।
প্যালিয়েটিভ কেয়ার একটি নাগরিক অধিকার। আমার বা আপনার যে কারোর যে কোন সময় এই সেবার প্রয়োজন হতে পারে। নিরাময় অযোগ্য রোগীর ক্ষেত্রে রোগের যে কোন সময় বা বয়স থেকেই রোগী এবং তার পরিবারের দৈনন্দিন কষ্টগুলোকে কমিয়ে আনা এবং জীবনের মান উন্নয়নে সহয়তা করাই এই সেবার মূল উদ্দেশ্য। সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা (ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ) এর প্রতি বাংলাদেশের সুদৃঢ় অবস্থানের অঙ্গীকারকে সম্মান জানিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে প্যালিয়েটিভ কেয়ার (প্রশমণ সেবা) কে অন্তর্ভুক্তকরণের দাবী তুলে এবারের প্রতিপাদ্য “হৃদয়ের ক্ষত নিরাময় ও জনসমাজ”।
শোকের অভিজ্ঞতা এবং নিরাময়ের প্রয়োজনীয়তা মানুষকে একত্রিত করে। বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ পরিবার এবং পরিচর্যাকারীরা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং কোথাও সম্পত্তি ধ্বংসের সম্মুখীন হওয়ার সময় পরিবার এবং বন্ধুদের মৃত্যুতে শোকাহত। এটি বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ মহামারী এবং সংঘাতের প্রভাবের কারণে ঘটেছে ও ঘটে চলছে।
বিশ্ব হসপিস ও প্যালিয়েটিভ কেয়ার দিবস, ২০২২ এমন একটি দিন যেখানে জনসমাজ, প্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা একত্রিত হন এবং রোগী ও তার পরিবারের শোক এবং শোকের চাহিদাগুলোকে সমর্থন করে এমন উপশমকারী যত্ন নীতি এবং কার্যক্রমগুলোর পক্ষে সমর্থন জানাতে সোচ্চার হন। শোকাহত মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য সারা বিশ্বে এই কার্যক্রমগুলো অনুষ্ঠিত হয় এবং সরকার ও নীতিনির্ধারকদেরকে শোকাহতদের বিভিন্ন প্রয়োজন এবং তহবিল প্রদানের জন্য জাতীয় পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে বলে।
প্যালিয়েটিভ কেয়ার নিরাময় অযোগ্য ও জীবন সীমিতকারী রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তি ও তার পরিবারের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক প্রয়োজন নিরূপণ ও সমাধানের জন্য একটি বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা। নিরাময় অযোগ্য বিভিন্ন রোগ যেমন ক্যান্সার, এইডস, কিংবা প্রান্তিক পর্যায়ের হার্ট ফেইলিউর, কিডনি অথবা ফুসসুসের রোগ, স্ট্রোক, ডিমেনশিয়া ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত মানুষ এবং তাদের পরিবার এই সেবা ব্যবস্থায় উপকৃত হতে পারেন। সেবা দানের ক্ষেত্রে রোগী বা তার পরিবারের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। রোগির শেষ দিনগুলোর ভোগান্তি কমানোর উদ্দেশ্যে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়। প্যালিয়েটিভ কেয়ার মৃত্যুকে তরান্বিত বা দেরী করায় না, বরং মৃত্যুকালীন ভোগান্তি লাঘবে চেষ্টা করে ।
গ্লোবাল অ্যাটলাস অফ প্যালিয়েটিভ কেয়ার, ২০২০ অনুসারে, প্রতি বছর ৫৬.৮ মিলিয়নেরও বেশি লোকের প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রয়োজন অনুমান করা হয়েছে যার মধ্যে ৩১.১ মিলিয়ন প্রাথমিক পর্যায়ে এবং ২৫.৭ মিলিয়ন জীবনের শেষের দিকে। এর প্রায় ৬৭ শতাংশ ৫০ বছরের বেশি বয়সী এবং কমপক্ষে ৭ শতাংশ শিশু। প্রায় ৫৪ শতাংশ মানুষের জীবনের শেষ সময়ে উপশমকারী যত্ন প্রয়োজন। সারা বিশ্বের এই চাহিদার ১০ শতাংশেরও কম পূরণ করা সম্ভব হয়। গুরুতর অসুস্থতা এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত দুর্ভোগের বোঝা, এবং প্যালিয়েটিভ কেয়ারের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তবুও বেশিরভাগ অভাবী মানুষের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে এই সেবা এখনও অনুকূলে নয়।
বিশ্বব্যাপি প্যালিয়েটিভ কেয়ারের চাহিদার ১২ শতাংশেরও কম মেটানো সম্ভব হয়। বাংলাদেশে বছরের যে কোন সময় প্রায় ৬ লক্ষ মানুষের প্যালিয়েটিভ কেয়ার প্রয়োজন। সারা দেশে বিক্ষিপ্ত ভাবে মাত্র অল্প কিছু স্থানে এই সেবার প্রচলন আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুবন্ধ ৬৭.১৯ তে প্যালিয়েটিভ কেয়ারকে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে অন্তর্ভুক্তকরণের সুপারিশ করা হয়েছে যার অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) ৩.৮ এ উল্লিখিত সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিধি (UHC) অর্জনের অন্যতম প্রধান অংশ এই প্যালিয়েটিভ কেয়ার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগ ২০০৭ সাল থেকে এ সেবা প্রদান করে আসছে। বহিঃর্বিভাগ, অন্তঃবিভাগ, দিবা সেবা, লিম্ফিডিমা কেয়ার, রেজিস্টার্ড রোগীদের জন্য ২৪ ঘন্টা টেলিফোন সার্ভিস, বিনামূল্যে গৃহ সেবা প্রদান সহ করাইল এবং নারায়ণগঞ্জে কমিউনিটি লেভেলে জনসাধারণের মাঝে এই সেবা নিশ্চিত করে আসছে এই বিভাগ। এছাড়াও এই বিভাগের পক্ষ থেকে ডাক্তার, নার্স, প্যালিয়েটিভ কেয়ার সহকারী (পিসিএ), স্বেচ্ছাসেবক এর পাশাপাশি রোগীর পরিবার বা পরিচর্যাকারীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
সম্প্রতি সরকার কিছু আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ নিয়েছেন যেমন- জাতীয় উপশমকারী যত্ন নির্দেশিকা, ডাক্তার, নার্স এবং প্যারামেডিকদের জন্য উপশমকারী যত্ন প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল তৈরি। প্রায় ২৪০ জন সরকারি চিকিৎসকের একটি দল খুব সম্প্রতি প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগ দ্বারা প্রদত্ত প্যালিয়েটিভ কেয়ারের ওপর ৩-দিনের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও তা চলমান থাকবে।