সাথিরা জাকির জেসি শেষবার যখন বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের হয়ে ক্রিকেট খেলেন, তখন ম্যাচ ফি ‘পেতেন না’। সেটা ২০১৩ সালের কথা। সময়ের ব্যবধানে লাল-সবুজ ক্রিকেটের নারী খেলোয়াড়েরা এই বিশ্বকাপে ম্যাচপ্রতি যখন ২৫ হাজার টাকা পাচ্ছেন, তখন তামিম ইকবালরা খেলেছেন গেছেন তিন লাখ টাকায়।
নারী এবং পুরুষদের এই বৈষম্যকে বিসিবির কর্মকর্তারাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি বলে মন্তব্য করেছেন। বোর্ডের উইমেনস উইংয়ের প্রধান শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন, এক বছরের মধ্যে আরও বৈষম্য কমিয়ে পুরুষ ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফির অন্তত অর্ধেক করবেন নারীদের জন্য।
পুরুষ বনাম নারী ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিকের বিষয়টি আসলেই ‘জনপ্রিয়তা এবং আয়ের’ প্রসঙ্গ সামনে আনেন অনেকে। বলা হয়, পুরুষ ক্রিকেটারদের দিয়ে বোর্ড যত আয় করে নারী বিভাগ থেকে ততটা হয় না। আবার তাদের জনপ্রিয়তাও সাকিব আল হাসানদের মতো নয়।
তবে গত কয়েক বছরে এই চিত্র বদলে গেছে। নারী ক্রিকেটারদের খেলা থাকলে সাধারণ মানুষদের তুমুল আগ্রহ দেখা যায়।
শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল অবশ্য এই সব যুক্তিতে না গিয়ে সোজাসুজি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির দোষ দিয়ে বলেন, “আমি এটার খুব সরল স্বীকারোক্তি দেই। আমরা যা-ই বলি না কেন আমাদের তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। আমরা ছেলেদের যতটা গুরুত্ব দেই, মেয়েদের ক্ষেত্রে অতটা দেই না। এটা সকলের ক্ষেত্রেই…আমি বলেন, আপনি বলেন, বিভিন্ন কর্নার থেকে আমরা যতই জেন্ডার নিয়ে কথা বলি না কেন, বাস্তবে যখন যাই বিরাট পার্থক্য দেখা দেয়।’’
‘‘আগে যেহেতু বৈষম্য বেশি ছিল, আমরা ক্রমান্বয়ে কমানোর চেষ্টা করছি। একধাপে বা একসঙ্গে বাড়ানো যায় না। হয়তো আরও ছয়মাস পরে আরও বাড়াব। বোর্ড প্রেসিডেন্ট খুবই আন্তরিক। উনি আমাদেরকে বাড়ানোর বিষয়গুলো পরামর্শ দিয়ে থাকেন।’’
‘‘আমরা গত তিন বছরে তালিকাভুক্ত নারী ক্রিকেটারদের সংখ্যা ২৪ জনে নিয়েছি। চারটি ভাগে তাদেরকে পারিশ্রমিক দিচ্ছি। তাদের ম্যাচ ফি আজ থেকে তিন বছর আগে যা ছিল, তার তিনগুণ আমরা প্রায় বাড়িয়েছি। আগে ছিল ১০০ ডলারের নিচে, এখন ৩০০ ডলার।’’
‘‘তাদের আসা-যাওয়ার ব্যবস্থায়ও এসেছে পরিবর্তন। প্লেন থাকলে প্লেন; না হলে এসি বাস। তাদের ক্যাম্পের জন্য মিরপুর স্টেডিয়ামের পাশে আমরা দুটো অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছি। যাতে করে তারা সেখানে খুব ভালোভাবে এবং নিরাপদে থাকতে পারেন।’’
ক্রিকেট বোর্ডের দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পুরুষ ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হয়। সেই সময় জানানো হয় একজন খেলোয়াড় প্রতি ওয়ানডে খেলে পাবেন ৩ লাখ টাকা (আনুমানিক ৩৫০০ ডলার)। টেস্টে দ্বিগুণ। তখন নারীদের ম্যাচ ফি ছিল ১০০ ডলার।
নারীদের পারিশ্রমিক নিয়ে সব পেশার মতো দেশে-দেশে খেলাধুলায়ও এমন বৈষম্য অনেক পুরোনো। অধিকাংশ দেশের নারীরা এই শেকল ছিঁড়তে না পারলেও যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল দলের নারীরা পেরেছেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঐতিহাসিক রায়ে পুরুষদের সমান পারিশ্রমিক পাওয়ার সুযোগ অর্জন করেন তারা। ছয় বছরের আইনি লড়াইয়ের পর দেশটির ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউএস সকার ফেডারেশন সব প্রতিযোগিতার জন্য পুরুষ এবং নারীদের সমান পারিশ্রমিক দিতে রাজি হয়।
বাংলাদেশে সমান না হলেও অর্ধেক পেতে কতদিন লাগতে পারে-এমন প্রশ্নের জবাবে নাদেল বলেন, ‘‘আমরা বছরখানেকের মধ্যে ওই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা রাখি। দেখুন প্রথমে ১০০ ডলার ছিল, সেখান থেকে ৩০০ ডলারে এনেছি। এটা আমরা করেছি বছর দেড়েক আগে। আরও ছয়মাস এক বছর গেলে আরও কয়েক শ ডলার বাড়িয়ে একটা জায়গায় আনার চেষ্টা করব।’’
‘‘আমরা বয়সভিত্তিক পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট শুরু করেছি। স্কুল ক্রিকেটও এ বছর শুরু করব। গত তিন-চার বছরে প্রমীলা ক্রিকেটারদের জন্য এই আর্থিক সুযোগ এবং পদক্ষেপগুলো নিয়েছি।’’
নারী ক্রিকেট দলের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন ক্রিকেট বিশ্লেষক ও কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিম। দেশের ক্রিকেটের অনেক চড়াই-উতরাই দেখা এই ক্রিকেটবোদ্ধা বলেন, ‘‘নারী ক্রিকেটকে এখনো আমরা অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে পারিনি। তারতম্য অনেক বড়। ছেলেরা যে পরিমাণ পারিশ্রমিক পায়, সেই তুলনায় মেয়েদের পাওয়াটা অনেক নগণ্য। কিছু মেয়ে হয়তো ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়, ম্যাচ ফি পায়, চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড় হিসেবে পারিশ্রমিক পায়। এদের বাইরে ঘরোয়া ক্রিকেটে কিছু কিছু মেয়ে উপার্জন করে। বাকিদের কিন্তু নিজেদের অর্থে খেলার আগ্রহ বাঁচিয়ে রাখতে হয়। মেয়েদের জন্য ভেরি ভেরি ডিফিকাল্ট।’’
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নারী ক্রিকেটারদের আর্থিক টানাপোড়নের বিষয়ে বলেন, “ওরা ক্রিকেট খেলে কতটাকা উপার্জন করে সেটা তো আমি বুঝতে পারতাম। স্ট্যান্ডার্ড লিভিংয়ের জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়। যারা জাতীয় দলে খেলছে না তাদের ইনভেস্টমেন্টও কিন্তু অন্যদের মতো। অনুশীলন করতে হয়। জিম করতে হয়। খাওয়া-দাওয়া ঠিকভাবে করতে হয়। একটা ভালো লাইফ লিড করতে হয়। তারা অনেক খরচ করে। সব মিলিয়ে ওদের বছরে অনেক খরচ যায়। সেই তুলনায় রিটার্ন খুবই কম পায়। তার পরের স্টেজে যারা আছে, তারা হয়তো কিছুই পায় না।’’
এখন থেকে ৯ বছর আগের কথা উল্লেখ করে ক্রিকেটার জেসি বলেন, ‘আমি জাতীয় দলের হয়ে শেষ খেলেছি ২০১৩ সালে, সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে। তখন ম্যাচ ফি ছিলই না।”
‘‘প্রিমিয়ার লিগে ম্যাচ ফি নেই। টিমগুলোর সঙ্গে চুক্তি হয়। সেটা মোটামুটি ভালো। রুপালি ব্যাংক টিম করার পর থেকে পেমেন্ট ভালো জায়গায় এসেছে। যেহেতু ব্যাংকের টাকার সমস্যা নেই। এটা দিনে দিনে বাড়লেও ছেলেদের তুলনায় অনেক কম। সাকিব কিংবা তামিমের পেছনে যে বাজেট থাকে, তা দিয়ে নারী ক্রিকেটারদের একটা টিমই করে ফেলে অধিকাংশ ক্লাব।’’
কেন এই বৈষম্য? জেসির উত্তর, ‘‘সব কিছু নির্ভর করে স্পন্সরের ওপর। ক্লাবগুলোর টাকা আসে তাদের থেকে। স্পন্সররা খুব বেশি আগ্রহী না হলে টাকা আসে না।’’
জাতীয় লীগের ম্যাচ ফির কথা জানতে চাইলে আক্ষেপ করে বলেন, “জাতীয় লিগে ম্যাচ ফি বলা না বলা একই কথা। প্রিমিয়ার লিগে কে কোথায় খেলছে এটার ওপর নির্ভর করে। একদম হাতেগোনা কিছু খেলোয়াড় টাকা পাচ্ছে। প্রিমিয়ারে যে দশটা টিম খেলে, তার চারটি টিম মোটামুটি ভালো হয়-আবাহনী, মোহামেডান, রুপালি ব্যাংক, খেলাঘর। আর বিকেএসপি তো পেমেন্ট করে না। ওদের স্টুডেন্টরা খেলে। আরেকটা হয়তো শেখ রাসেল। এখানে যারা প্রথম সারিতে থাকে, তারা হয়তো একটু পেমেন্ট পায়। অন্যদের অবস্থা খুবই খারাপ।’’ সূত্র: ভয়েস অব আমেরিকা