বাংলাদেশে রকেট তৈরির আইডিয়া দিয়ে দুই উদ্ভাবক ‘রকেট্রি ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ-২০২২’ এর সেরা উদ্ভাবক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। আগামী মার্চ মাসের মধ্যেই উড্ডয়নের অপেক্ষায় বাংলাদেশে তৈরি সেই প্রথম রকেট।
বুধবার (১৮ জানুয়ারি) রাজধানীর বিএএফ শাহীন হলে এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমআরএএইউ)-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত রকেট্রি ইনোভেশন চ্যালেঞ্জের বিজয়ী উদ্ভাবকদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এয়ার ভাইস মার্শাল এ এস এম ফখরুল ইসলাম।
শিক্ষামন্ত্রী ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী পুরস্কার হিসেবে বিজয়ী উদ্ভাবক আজাদুল হককে (ব্রিজ টু বাংলাদেশ) এক কোটি টাকা এবং উদ্ভাবক নাহিয়ান আল রহমান অলিকে (ধুমকেতু এক্স) ৫০ লাখ টাকার সিডমানি এবং সার্টিফিকেট তুলে দেন।
রকেট নির্মাণ-উৎক্ষেপণ, উড্ডয়ন-পরীক্ষণ, গবেষণা-উন্নয়ন এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য কার্যক্রমে আগ্রহ বৃদ্ধি এবং দেশে একটি রকেট্রি ইকোসিস্টেম তৈরির লক্ষ্যে এটুআই এবং বিএসএমআরএএইউর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত রকেট্রি ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ ২০২২ আয়োজন করা হয়েছে।
এ প্রতিযোগিতায় সারাদেশ থেকে আসা ১২৪টি উদ্ভাবনী আইডিয়া থেকে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই, বুটক্যাম্প, গ্রুমিং এবং টেকনিক্যাল ইভালুয়েশন প্যানেলসহ কয়েকটি ধাপের মাধ্যমে বিচারকমণ্ডলী দুইটি আইডিয়াকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন।
উদ্ভাবক আজাদুল হক বাংলাদেশে মডেল রকেট উৎক্ষেপণের জন্য ইকোসিস্টেম বা সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া তৈরির পাশাপাশি রকেট্রি গবেষণা এবং উন্নয়নে একটি সংবেদনশীল এবং নিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্র তৈরি করবেন। স্বতন্ত্র রকেটিয়ারদের নিজস্ব লঞ্চের অনুমতি চাওয়া উচিত নয়। রকেট তৈরির ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে এবং শুধুমাত্র অনুমোদিত রকেটগুলোকে উৎক্ষেপণের অনুমতি দেওয়া উচিত।
উদ্ভাবক নাহিয়ান আল রহমান অলির ধুমকেতু ০.১ এর নকশা পরীক্ষা করার জন্য একটি প্রোটোটাইপ রকেট, রকেট উৎক্ষেপণ এবং নিয়ন্ত্রণ করতে নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এটি ১০ হাজার ফুট থেকে ৩০ হাজার ফুট দূরের বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম এবং এতে দেশের মহাকাশ প্রযুক্তির যাত্রার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
শিক্ষামন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশে তথ্য-প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নের পাশাপাশি মহাকাশ গবেষণায় উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে মহাকাশ বিষয়ক উচ্চ শিক্ষার জন্য সরকার ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারো স্পেস বিশ্ববিদ্যালয়।
এছাড়া মহাকাশ গবেষণায় দেশীয় সক্ষমতা অর্জনে একদল দক্ষ পেশাদার মানব সম্পদ তৈরির উদ্দেশ্যে ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করার কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, এ ধরনের গবেষণা খাতের উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করতে পারলেই আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশকে একটি প্রযুক্তিনির্ভর দেশ হিসেবে বিশ্ব সভায় রোল মডেল তৈরির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টাকে সফল করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষামন্ত্রী জানান, স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিজয়ী উদ্ভাবকদের তৈরি রকেট উড্ডয়ন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি আমরা।
জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ নেন, তখন অনেকেই বলেছেন আমাদের দেশের মানুষ তিনবেলা খেয়ে বেঁচে থাকলেই হয়, সেখানে কেন প্রধানমন্ত্রী এই উদ্যোগ নিচ্ছেন? কিন্তু আজ ১৪ বছর পর করোনাকালীন বাংলাদেশের সব মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ সফলভাবে বাস্তবায়ন না করলে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে শিক্ষা-বাণিজ্য-বিচার ব্যবস্থা চলমান রাখতে পারতাম না। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক এবং উন্নত আয়ের উদ্ভাবনী বাংলাদেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। এটি বাস্তবায়নে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলেই আমরা আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবো।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্বল্প ও দীর্ঘ পরিকল্পনা প্রণয়ন করছি, যার মূল স্তম্ভ হবে চারটি-স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি। আমাদের সব পেশার কর্মকর্তাদের পাশাপাশি নাগরিকদের বুদ্ধিদীপ্ত ও উদ্ভাবনী হিসেবে গড়ে তুলে স্মার্ট সিটিজেন হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ইতোমধ্যে আমরা স্মার্ট লিডারশিপ একাডেমি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। লেনদেনের ক্ষেত্রে ক্যাশলেস, ট্রান্সপারেন্ট এবং অ্যাকাউন্টেবল পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হবে। এতে দুনীর্তিমুক্ত জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা প্রণয়ন করে একটি স্মার্ট ইকোনমি তৈরি করা সম্ভব হবে। সরকারের সব কার্যক্রমে পেপারলেস অফিস বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে একটি স্মার্ট গভর্নমেন্ট তৈরি করা হবে। স্মার্ট এগ্রিকালচার, স্মার্ট হেলথ কেয়ারসহ সব কার্যক্রম নিয়ে আমরা একটি স্মার্ট সোসাইটি গঠন করবো।
প্রতিমন্ত্রী উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করার ওপর গুরত্বারোপ করে বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে প্রয়োজন হলে আমরা প্রতি রাউন্ডে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত ফান্ড দিতে প্রস্তুত আছি।
বিএসএমআরএএইউর উপাচার্য এয়ার ভাইস মার্শাল এ এস এম ফখরুল ইসলাম বলেন, অবকাঠামো ও যোগ্য শিক্ষকসহ আমাদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কর্তৃক নিজস্ব ক্যাম্পাস স্থাপন এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর উচ্চশিক্ষিত চৌকস কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিমান বাহিনী পাশে থাকায় আমরা খুব দ্রুততম সময়ে যেকোন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি।
এটুআইর প্রকল্প পরিচালক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর বলেন, ২০৪১ সালে আমরা আমাদের নিজস্ব লঞ্চিং প্যাড থেকে নিজস্ব রকেট লঞ্চ করার উদ্দেশ্যেই এই রকেট্রি ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ শুরু করেছি। পরবর্তীতে আমরা স্পেস অ্যাপস, হ্যাকাথন, মার্স রোভার চ্যালেঞ্জসহ আরো কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করবো।
এটুআইর পলিসি অ্যাডভাইজর আনীর চৌধুরী বলেন, মানুষের উদ্ভাবনী চিন্তাগুলোকে মাঠ পর্যায় থেকে তুলে এনে সফলভাবে বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে এটুআই নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এটুআই ইতোমধ্যে ২৭৩টি উদ্ভাবনকে ইনোভেশন ফান্ড দেওয়া হয়েছে। এসব উদ্ভাবনের মধ্যে ইতোমধ্যে ডুয়েল সিস্টেম রেফ্রিজারেটর এবং স্বল্পমূল্যের ইলেক্ট্রিক যানবাহনসহ অনেকগুলো উদ্ভাবনকে বাজারজাতকরণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করা হচ্ছে। আমরা শুধু রকেট লঞ্চ নিয়ে ভাবছি না, বরং ভবিষ্যতে স্পেস ইকোনমি ও ইকোসিস্টেম নিয়ে কাজ করতে চাই। এ লক্ষ্যে স্পারসোর সাথে আমরা দ্রুতই কাজ শুরু করবো।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বাস্তবায়নাধীন ও ইউএনডিপির সহায়তায় পরিচালিত ‘এটুআই’ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমআরএএইউ) যৌথ উদ্যোগে বিগত ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ‘রকেট্রি ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ ২০২২’ এ অংশগ্রহণের জন্য আইডিয়া জমা নেওয়া শুরু হয়।
রকেট্রির প্রতি আগ্রহীদের গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্পৃক্ত করা ও উৎসাহ দেওয়ার লক্ষ্যে এই প্রতিযোগিতা চালু করা হয়। মডেল রকেটের নকশা তৈরি, নির্মাণ এবং উৎক্ষেপণের জন্য নিরাপদ ইকোসিস্টেম তৈরির উদ্দেশে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। যা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিতের শিক্ষার্থীদের মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী করে তুলবে।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বিএসএমআরএএইউর প্রো-উপাচার্য এয়ার কমোডর এ টি এম হাবিবুর রহমান; এটুআইর প্রকল্প পরিচালক (যুগ্মসচিব) ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর, এটুআই ইনোভেশন ফান্ড প্রধান নাঈম আশরাফী উপস্থিত ছিলেন।