প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের প্রথম মেট্রোরেল উদ্বোধনের মাধ্যমে বাঙালির গৌরব ও বাংলাদেশের উন্নয়ন মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত হয়েছে। সব বাধা মোকাবিলা করে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুর পর মেট্রোরেল উদ্বোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়নের যাত্রায় জনগণের মাথার মুকুটে অহংকারের আরও একটি পালক যোগ হয়েছে।’
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ছয় মাসের ব্যবধানে দেশের ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক স্থাপন করে দেশের প্রথম এলিভেটেড মেট্রোরেল উদ্বোধনের পর এক নাগরিক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, তার সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে সারা বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। আর মেট্রো রেল চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশ বৈদ্যুতিক, দূর নিয়ন্ত্রিত এবং দ্রুততম যোগাযোগের যুগে প্রবেশ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে দেশের প্রথম এলিভেটেড মেট্রোরেল উদ্বোধন করেন। তিনি দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬ দিয়াবাড়িতে এর ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে আংশিকভাবে উদ্বোধন করেন।
বেলা ১১টায় উত্তরার ১৫ নম্বর সেক্টরের ‘সি’ ব্লকের মাঠে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এ বৃহৎ অবকাঠামো উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করে বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতি সারবিশে^ মর্যাদা পেয়েছে। আজকে আমরা আরেকটি নতুন অহংকারের পালক বাংলাদেশের জনগণের মাথার মুকুটে সংযোজিত করলাম।’
সরকার প্রধান বলেন, ‘যেকোনো কাজ করতে গেলে অবশ্যই সাহসের প্রয়োজন হয়, সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকে প্রতিটি কাজ পরিকল্পনা নিয়ে সম্পন্ন করেছে। যে কারণে মাত্র ১৪ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’
তিনি বলেন, মেট্রোরেলের উদ্বোধনের ফলে একই সঙ্গে প্রযুক্তিতে চারটি মাইলফলক ছুঁলো বাংলাদেশ। প্রথমত, মেট্রোরেল নিজেই একটি মাইলফলক। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে প্রথম বৈদ্যুতিক যানের যুগে প্রবেশ করলো। তৃতীয়ত, ডিজিটাল রিমোট কন্ট্রোল যান এটি, যেটি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি ধাপ। চতুর্থত, বাংলাদেশ দ্রুত গতি সম্পন্ন যানের যুগে প্রবেশ করলো। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলবে মেট্রোরেল।
শেখ হাসিনা বলেন, মেট্রোরেল পরিচালনায় অন্য দেশের ওপর নির্ভরতা থাকবে না। এটি পরিচালনায় আমরা নিজেরাই স্মার্ট নাগরিক তৈরি করবো। এটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব হবে।
অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং বাংলাদেশে জাইকার প্রধান প্রতিনিধি ইচিগুচি এবং বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি বক্তব্য দেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রওশন আরা মান্নান এমপি অন্যান্যের মধ্যে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী স্বাগত বক্তব্য দেন এবং ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক মেট্রোরেলের অগ্রগতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে দিনটি উপলক্ষ্যে স্মারক ডাকটিকেট, ৫০ টাকার ম্মরক নোট, খাম এবং ডাটা কার্ড অবমুক্ত করেন।
পরে প্রধানমন্ত্রী টিকেট কাউন্টার থেকে মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে ইটিকেট ক্রয় করে মেট্রোরেলের প্রথম যাত্রী হন। তাঁর বোন শেখ রেহানাও টিকিট ক্রয় করে প্রথম যাত্রায় তাঁর সঙ্গী হন। তিনি স্টেশনে একটি গাছের চারাও রোপণ করেন।
জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদসবৃন্দ, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ, সভাপতিমন্ডলীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ, পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি ও কূটনিতিকসহ আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি আধুনিক একটি পরিবহন ব্যবস্থা এবং পুরোপুরি এই আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা যখন চালু হবে এটি চালু রাখতে আমাদের প্রকৌশলীদের ট্রেনিং অব্যাহত থাকবে। উপরন্তু এটার নিরাপত্তার সাথে যারা থাকবে শুধু ডিএমটিসিএল-এর অধীনে নতুন ১২ হাজার গ্রাজুয়েট প্রকৌশলী ও মাঠ প্রকৌশলীদের কর্মসংস্থান হবে। যার মাধ্যমে শুরু শুধু বেকারত্বই দূর হবে না দক্ষ জনশক্তিও গড়ে উঠবে। অর্থাৎ এর ধারবাহিকতায় ফরোয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে ওঠার মাধ্যমে আরো নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ফলে, মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনার জন্য বিদেশি শক্তির ওপর বাংলাদেশকে নির্ভর করতে হবে না।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ চালিত এই মেট্রো রেল শব্দ এবং কম্পন দূষণমাত্রা মানদন্ড সীমার অনেক নীচে থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০৩০ নাগাদ সম্পূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দৈনিক প্রায় ৫০ লাখ ৪০ হাজার যাত্রী মেট্রোরেল ব্যবহার করে যাতায়াত করতে পারবে এবং বছরে ২ লাখ মেট্রিক টন কার্বন নিঃসারণও হ্রাস পাবে।
মেট্রোরেল নির্মাণকালীন সহযোগিতার জন্য তিনি এলাকাবাসীকে ধন্যবাদ জানান এবং নির্মাণকালীন নানা জনদুর্ভোগের জন্যও দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সেই দিন এখন শেষ।
নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রথম পর্যায়ে মেট্রোরেল উদ্বোধনে সক্ষম হওয়ায় তিনি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সকলকে এবং জাইকাসহ উন্নয়ন সহযোগীদের ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশান হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে এক অনাকাঙ্খিত বিয়োগান্তক ঘটনায় এমআরটি লাইন-১ এবং এমআরটি লাইন-৫ এ কর্মরত ৭ জন জাপানী পরামর্শক নিহত হবার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
তাঁদের স্মরণে বাংলাদেশ ও জাপান সরকারের যৌথ উদ্যোগে উত্তরা দিয়াবাড়িতে মেট্রোরেল প্রদর্শনী ও তথ্য কেন্দ্রে স্মৃতিস্মারক স্থাপন করা হয়েছে, যা পরবর্তীতে এমআরটি লাইন-১ এবং এমআরটি লাইন-৫ নর্দার্ন রুটের নতুন বাজার আন্তঃলাইন সংযোগ স্টেশনে স্থানান্তর করা হবে বলেও জানান তিনি।
তিনি এই মেট্রোলের জনগণের সম্পদ বিধায় সবাইকে এর সুরক্ষায় যতœবান হবারও পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, ‘অনেক টাকা খরচ করে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মেট্রোরেল গড়ে তোলা হয়েছে। তাই, যারা ব্যবহার করবেন তারা একটু সচেতন হবেন। এর মান নিশ্চিত রাখা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রাখার চেষ্টা করবেন। এসব আধুনিক ডিজিটাল ডিভাইস যাতে নষ্ট না হয়। নিয়মতান্ত্রিকভাবে এটাকে ব্যবহারের জন্য আমি সবার কাছে আবেদন জানাচ্ছি।’
কোভিড-১৯ এর অভিঘাত মোকাবিলা করেও বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চাইতে ‘অগ্রগামী’ অবস্থানে রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সাহসের সাথে করোনা যেমন মোকাবিলা করেছি, পদ্মা সেতু যেমন করেছি তেমনি দেশের উন্নয়ন কাজও এগিয়ে নিয়ে যাব।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শের সৈনিক আমরা। আর আওয়ামী লীগ সেই দল যে দলকে নিয়ে জাতির পিতা এদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। কাজেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশের মানুষের উন্নতি হয়। দেশের মানুষের অগ্রযাত্রা বৃদ্ধি পায়। আজকে সেটাই প্রমাণিত সত্য।
-বাসস