আবুল কালাম আজাদ(রাজশাহী): রাজশাহীর আম আর লিচুর নাম শুনলে জিহবায় জল আসবে না, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পৃথিবীর সেরা আম- লিচুর জন্ম রাজশাহীর উর্বর ভূমিতেই— তা নিয়ে নতুন করে আসলে বলার কিছুই নেই। বিশেষত ফলের রাজা ফজলির যে সমাহার রাজশাহী-চাপাই জুড়ে, তা নিয়ে গর্ব করে অঞ্চলটি। মিষ্টান্নসামগ্রীর জন্যও রাজশাহীর মিষ্টির একটা আলাদা পরিচিতি রয়েছে। এ ছাড়া রেশমীবস্ত্রের কারণে রাজশাহীর আরেকনাম ‘রেশমী-নগর’। এসব তো গেলো রাজশাহীর ঐতিহ্যগত পরিচিতি। ইদানিং রাজশাহী পরিচিতি পেয়েছে সবুজের নগরী হিসেবে। সেই সঙ্গে দেশের অন্যতম পরিচ্ছন্ন শহরের তালিকায় রাজশাহীর নাম সবার আগে চলে আসবে অনায়াসে। যার সিংহভাগ অবদান রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের প্রাপ্য । রাজশাহী সিটি করপোরেশনের পথচলা শুরু ১৯৯১ সালে। সেই থেকেই রাজশাহী একটু একটু করে এগিয়েছে শহরায়নের দিকে। যদিও সে শহর ছিল ঘিঞ্জ , পরিকল্পনাহীন আর যানজটের নগরী। উপরন্ত পদ্মাপাড়ের শহর হিসাবে সারা শহর ঘুলো আর বালিতে আচ্ছন্ন থাকত। রাজশাহীকে আধুনিক নগর হিসেবে গড়ে তোলার সূচনা মূলত ২০০৮ সালের পর থেকে। সেই সময়েই রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে প্রথম দায়িত্ব পান খায়রুজ্জামান লিটন। রাজশাহীর রাস্তাঘাট প্রশস্ত করাসহ নানারকম নগর উন্নয়নে হাত দেন খায়রুজ্জামান লিটন। তবে সেই উদ্যোগ চলমান থাকেনি। কারণ ২০১৩ সালের নির্বাচনে তিনি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে খায়রুজ্জামান লিটন দ্বিতীয়বার ‘মেয়র’ নির্বাচিত হওয়ার পর বদলাতে শুরু করে রাজশাহীর ভাগ্য । দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতার চার বছর পার করেছেন মেয়র খায়রুজ্জামানল লিটন। রাজশাহী বদলে গেছে। যে কোনো পর্যটক শুরুতেই অবাক হবে রাজশাহীর সবুজ-রূপ দেখে। সড়ক বিভাজক, সড়ক দ্বীপে এবং ফুটপাতে লাগানো বিভিন্ন প্রজাতির নানান রঙের ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে মহানগরী। যা রাজশাহীতে ঘুরতে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ সকলেরই নজর কাড়ছে, শহরের সৌন্দর্য্য মুগ্ধ করছে সবাইকে। যার স্বপ্নদ্রষ্টা খায়রুজ্জামান লিটন। বর্তমান গ্লোবাল-ওয়ার্মিংয়ের যুগে বৃক্ষরাজি কমে যাওয়ার কুফল আমরা এরইমধ্যে পেতে শুরু করেছি। বেড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর উত্তাপ। বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ এখন শুধু বই-পুস্তক আর ইতিহাসের গল্প। মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন ‘প্রকৃতিপ্রেমী’ মানুষ হিসেবে বৃক্ষায়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে ভুল করেননি। তিনি বুঝেছেন, মহানগরীর মানুষকে নির্মল বাতাসে বিশুদ্ধ শ্বাস নেয়ার ব্যবস্থা করতে বাড়াতে হবে অক্সিজেনের জোগান। আর সেই জন্য চাই ব্যাপক বৃক্ষায়ন। সেই কাজ তিনি হাতে নিলেন। তদারকির দায়িত্বে থাকলেন। রাসিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রথমবার মেয়র থাকাকালীন রাজশাহী মহানগরীকে সবুজের মহানগরীতে পরিণত করতে দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন সিটি মেয়র এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটন।
এরই অংশ হিসেবে ‘জিরো সয়েল প্রকল্প’ নামক সবুজায়ন প্রকল্প করে রাজশাহী সিটি করপোরেশন। পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব ঠেকাতে, শহরের রাস্তা ও ফুটপাথ বাদে অবশিষ্ট ফাঁকা জায়গা সবুজ গাছে ঢেকে দিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সবুজ ও ফুলে ফুলে নবরূপ পেয়েছে গ্রীনসিটি খ্যাত রাজশাহী মহানগরী। ২০১৮ সালের ৫ অক্টোবর দ্বিতীয়বারের মতো মেয়রের দায়িত্বগ্রহণের পর প্রথমেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও সবুজায়ন ও ফুলে ফুলে সাজাতে নানবিধ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেন মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন। এরফলে রাজশাহী মহানগরী এখন ক্লিনসিটি, গ্রিন সিটি ও ফুলের সিটিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে সবুজ হয়েছে শহরের প্রায় ২৪ কিলোমিটার রাস্তার সড়ক বিভাজক ও সড়ক দ্বীপ। নগরীর প্রধান সড়ক বিভাজক, সড়ক দ্বীপে এবং ফুটপাতে লাগানো হয়েছে সৌন্দর্যবর্ধক বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এইগুলোর মধ্য উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পাম, রঙ্গন, কাঠ করবি, চেরি, এ্যালামুন্ডা, জারুল, সোনালু, বকুল, কৃষ্ণচূড়া, মহুয়া, হৈমন্তী, রাধাচূড়া, কাঞ্চন ইত্যাদি। এর ফলে বাতাসে ভাসমান মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক ক্ষুদ্র ধুলিকণা মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি পুরো নগরীর সৌন্দর্য্যও বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহী নগরীর উন্নয়নে তিন হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে ‘একনেক’। এটি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে একক সর্ববৃহৎ প্রকল্প। যে উন্নয়ন প্রকল্পের প্রধান চরিত্র খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি রাজশাহী নগরীর পুরোচিত্র বদলে দেওয়ার সংকল্পে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। দুই বছরেই যার সুফল পেতে শুরু করেছে নগরবাসী। মেয়র লিটন বলেন, ‘রাজশাহী নগরীর সার্বিক উন্নয়ন করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এই শহরকে একটি উন্নত শহর হিসেবে গড়ে তুলতে এটিকে ঢেলে সাজাতে চাই। এর জন্য যা যা করার দরকার, তাই করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায় রাজশাহীকে আমরা পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন কাজ হাতে নিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায় রাজশাহীকে আমরা পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছি আমরা।’ রাজশাহীতে বর্তমানে কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। এরমধ্যে অন্যতম বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক। যার বেশির ভাগ অংশ এখন দৃশ্যমান। বিশাল কর্মযজ্ঞে মাথাচাড়া দিয়েছে পদ্মাপাড়ের বিশাল বিশাল অবকাঠামো। যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির আদলে নির্মাণ করা হচ্ছে এটি। এরইমধ্যে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে শেখ কামাল আইটি ইনকিউবেশন এ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার চালু হয়েছে। হাইটেক পার্ক পুরো চালু হলে তথ্য প্রযুক্তিখাতেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে রাজশাহী ভিত্তিক অন্তত ৪০ হাজার তরুণ-তরুণীর। খায়রুজ্জামান লিটন শুধু মহাপরিকল্পনা নিয়েই ব্যস্ত থাকছেন না। নগরী কয়েকটি পুকুর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। যা এখন বিনোদন স্পট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রায় দুই ডজন পুকুরের পাড় বাঁধানো, সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে সেগুলোকে বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে রূপ দেওয়ার ‘আইডিয়া’ তার। মেয়র জানান, এর মধ্য দিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা যেমন হবে,সৌন্দর্যও বাড়বে।
সিটি করপোরেশন কাউন্সিলর, কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও নাগরিকদের মাধ্যমে রাজশাহীতে বৃক্ষরোপণ এখন রুটিন কাজ। রাজশাহী সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, রাজশাহী নগরীর পদ্মা নদী তীরবর্তী এলাকা সংস্কার ও সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে পদ্মাপাড়ের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শুরু করা হবে। যা রাজশাহীবাসীর বহুদিনের দাবি। তবে নদীতীরবর্তী এলাকার একটি বড় অংশ এখন অবৈধ দখলদারদের সরাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে ।
পদ্মাপাড় রাজশাহী মহানগরীর অন্যতম উন্মুক্ত বিনোদন কেন্দ্র। পদ্মাপাড় সংলগ্ন দরগাপাড়ায় অবস্থিত হযরত শাহমখদুম রূপোশ (রহ) মাজার শরীফ। পদ্মাপাড়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে লালনশাহ পার্ক। শাহমখদুম রূপোশ (রহ) মাজার শরীফ ও পদ্মাপাড়ের সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন ছুটে আসেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য দর্শনার্থী। নগরবাসীর বিনোদনের জন্য নগরীর অন্যতম বিনোদন কেন্দ্রকে আরও আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন করতে উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করছে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন। বর্তমানে ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকার উন্নয়ন কাজ চলমান আছে শুধু শহর সৌন্দর্যের বিকাশে। হযরত শাহ মখদুম (রহ) মাজার সংলগ্ন এলাকায় একটি ও পদ্মা গার্ডেন সংলগ্ন এলাকায় আরেকটি ঝুলন্ত ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে।
পরিবেশ উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে রাজশাহী। এরইমধ্যে সবচাইতে পরিবেশবান্ধব শহর হিসেবে রাজশাহী অর্জন করেছে ‘এনভায়রনমেন্ট ফ্রেন্ডলি সিটি অব দ্য ইয়ার-২০২০’ সম্মাননা। চ্যানেল আই প্রকৃতি মেলা ১০ম বর্ষে পদার্পণে ১ম বারের মতো এ পদক প্রদান করা হয়। জিরো সয়েল প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বিপুল পরিমাণ বৃক্ষরোপণসহ বহুমুখী উদ্যোগের কারণে ২০১৬ সালে বাতাসে ক্ষতিকারণ ধূলিকণা কমাতে বিশ্বের সেরা শহর নির্বাচিত হয় রাজশাহী। এসবই হয়েছে একজন খায়রুজ্জামান লিটনের কারণে।
জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। ২০১২ সালের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পরিবেশ পদক গ্রহণ করেন তৎকালীন রাসিক মেয়র এ.এইচ.এম.খায়রুজ্জামান লিটন। একই বছর বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার এবং ২০০৯ সালেও বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার লাভ করে রাসিক।
রাজশাহীর উন্নয়নে গর্বিত নগরীর মানুষ । তারা তাদের নগর-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু কিছু ছোট ছোট অভিযোগ এখনও রয়ে গেছে। যেমন- শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন। বৃষ্টি হলে এখনও অনেক রাস্তায় পানি জমে । এছাড়া নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বারনই নদে স্যুয়ারেজের নোংরা পানির সংযুক্তি করে দেয়ার ফলে নদীর পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। দুর্গন্ধে দুই পাড়ের মানুষজন অতিষ্ঠ। মরে যাচ্ছে নদীর মাছ।
রাজশাহীতে একটি পূর্ণাঙ্গ টিভি স্টেশনের দাবি কয়েক দশকে পূরণ হয়নি । রাজশাহী বিমানবন্দরকে আঞ্চলিক বিমানবন্দরে রূপান্তর করার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না । নগরবাসীর আশা, তাদের নগর-প্রেমিক মেয়র এইসব দাবিও একদিন পূরণ করবেন।
মেয়র খায়রুজ্জামান, যিনি বাংলাদেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের সন্তান। যিনি একজন নির্লোভ, সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে পুরো বাংলাদেশে পরিচিত ছিলেন। সেই গুণী মহান পিতার সন্তান হিসেবে দেশপ্রেম আর সততা তার রক্তের মধ্যে। বাবার মতোই দেশের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন নিজেকে। তিনি স্বপ্ন দেখেন নিজের জন্মস্থানকে দেশের সবচেয়ে উন্নত নগরীতে পরিণত করার। সেটি শুধু আর্থ-সামাজিক বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন ন । তিনি নগরবাসীকে সুস্থ-সুখি জীবনের সুযোগ দেওয়ার ব্রত নিয়েছেন।বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটি প্রেসিডিয়াম সদস্য খায়রুজ্জামান লিটনের সব কাজ শেষ হয়নি। পর্যাপ্ত সময় আর সুযোগ পেলে তিনি কারও কোনো অভিযোগ করার সুযোগ রাখবেন না— এটিও বলে দেওয়া যায়। আর সেই সময় এবং সুযোগ ওনার মতো মানুষের প্রাপ্য। কারণ একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক আর সজ্জন চরিত্রের খায়রুজ্জামান লিটন কোটিতে বড়জোর এক-দুইটা মেলে ।