Friday , 19 April 2024
শিরোনাম

রামাদানে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও কতিপয় আমল – মাওলানা মোঃ রাহাত উল্লাহ

নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লী আলা রাসূলিহীল কারীম। সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য যিনি বান্দাকে সকল নেয়ামাত দ্বারা পরিপূর্ণ করেছেন। দরুদ তাঁর প্রিয় হাবিবে পাকের প্রতি যিনি বিশ্বের করুনার আধার হিসেবে মহান আল্লাহ যাকে মর্যাদা দিয়েয়েছেন। আজ পবিত্র মাহে রামাদানের ২য় জুমা মোবারক। জুমার দিন সপ্তাহের গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাবান দিবস।অন্যদিকে রামাদান ও জুমার সম্মিলীত মিলনে মুমিনের জন্য এর গুরুত্ব বেশ সম্মানীত।আল্লাহর কত দয়া যে ইসলামকে অনেক সহজ করেছেন মানুষের জন্য। পবিত্র রামাদানে সাহরী খাওয়া আমাদের নিজেদের জন্যই প্রয়োজন, অথচ আল্লাহ এ কাজটিকে ইবাদত বানিয়ে দিয়েছেন। খেলে আল্লাহ খুশি হন এবং সাওয়াব দেন। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ
সাহরী খেতে নির্দেশ দিয়েছেন। এক হাদীসে তিনি বলেন:

السَّحُورُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ فَلا تَدَعُوهُ وَلَوْ أَنْ يَجْرَعَ أَحَدُكُمْ جُرْعَةً مِنْ مَاءٍ فَإِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ وَمَلائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ

“সাহরী খাওয়া বরকত; কাজেই তোমরা তা ছাড়বে না; যদি এক ঢোক পানি পান করেও হয় তবুও; কারণ যারা সাহরী খায় তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ সালাত (রহমত ও দুআ) প্রদান করেন।”

১. কোনো কোনো হাদীসে সাহরীতে খেজুর খেতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সাহরী খাওয়ার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (দঃ) এর সুন্নাত ও শিক্ষা হলো একেবারে শেষ মুহূর্তে সাহরী খাওয়া। যাইদ ইবনু সাবিত বলেন:

تَسَحَّرْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلام ثُمَّ قُمْنَا إِلَى الصَّلاةِ قُلْتُ كَمْ كَانَ قَدْرُ مَا بَيْنَهُمَا قَالَ خَمْسِينَ آيَةً

“আমরা রাসূলুল্লাহ -এর সাথে সাহরী খেলাম এরপর ফজরের সালাতে দাঁড়ালাম। যাইদকে জিজ্ঞাসা করা হলো, মাঝে কতটুকু সময় ছিল? তিনি বলেন ৫০ আয়াত তিলাওয়াতের মত।”২ রাসূলুল্লাহ -এর সুন্নাত সুর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা। তিনি এত তাড়াতাড়ি ইফতার করতেন যে, অনেক সময় সাহাবীগণ বলতেন, হে আল্লাহর রাসূল, সন্ধ্যা হোক না, এখনো তো দিন শেষ হলো না! তিনি বলতেন, সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করতে হবে। বিভিন্ন হাদীসে রয়েছে যে, সাহাবীগণ সর্বদা শেষ সময়ে সাহরী খেতেন এবং সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করতেন। রাসূলুল্লাহ
বলেন:
لا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ

“যতদিন মানুষ সুর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন তারা কল্যাণে থাকবে।”

إِنَّا مَعْشَرَ الأَنْبِيَاءِ أُمِرْنَا بِتَعْجِيْلِ فِطْرِنَا وَتَأْخِيْرِ سُحُوْرِنَا

৩. “আমরা নবীগণ আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রথম সময়ে ইফতার করতে ও শেষ সময়ে সাহরী খেতে।”

৪. ইফতারের জন্য রাসূলুল্লাহ এর নির্দেশ হলো খেজুর মুখে দিয়ে ইফতার করা। তিনি সম্ভব হলে গাছ পাকা টাটকা রুতাব খেজুর, না হলে খুরমা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। খেজুর না পেলে তিনি পানি মুখে দিয়ে ইফতার করতেন। তিনি ইফতারিতে তিনটি খেজুর খেতে পছন্দ করতেন।

৫ . সাহরীর সময় রোযাদারদের ডাকা মুসলিম উম্মাহর একটি বরকতময় রীতি। বর্তমানে প্রত্যেক মসজিদে মাইক থাকার কারণে বাড়ি বাড়ি বা মহল্লার মধ্যে যেয়ে ডাকার রীতি উঠে গিয়েছে। মসজিদের মাইক থেকেই ডাকা হয়। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, ডাকার উদ্দেশ্য যারা সাহরী খেতে চান তাদেরকে ঘুম ভাঙ্গতে সাহায্য করা। এজন্য ফজরের আযানের ঘন্টাখানেক আগে কিছু সময় ডাকাডাকি করাই যথেষ্ট। বর্তমানে অনেক মসজিদে শেষ রাতে একদেড় ঘন্টা একটানা গজল-কিরাআত পড়া হয় ও ডাকাডাকি করা হয়। বিষয়টি খুবই নিন্দনীয় ও আপত্তিকর কাজ। অনেকেই সাহরীর এ সময়ে খাওয়ার আগে বা পরে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করেন, বা তিলাওয়াত করেন, কেউ বা সাহরী খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, কারণ সকালে তার কাজ আছে, অনেক অসুস্থ মানুষ থাকেন। এরা সকলেই এরূপ একটানা আওয়াজে ক্ষতিগ্রস্থ হন। বান্দার হক্কের দিকে আমাদের বিশেষ লক্ষ্য রাখা দরকার।সাহরী ও ইফতার খাওয়ার অর্থ এ নয় যে, সারাদিন যেহেতু খাব না, সেহেতু এ দু সময়ে দ্বিগুণ খেয়ে সারাদিন জাবর কাটব! এরূপ খেলে তো সিয়ামের মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট হলো। সাহরী ও ইফতার খাওয়ার অর্থ স্বাভাবিকভাবে আমরা যা খাই তা খাওয়া। সমাজে প্রচলিত আছে যে, সাহরী ও ইফতারীতে বা রামাদানে যা খাওয়া হবে তার হিসাব হবে না। এজন্য আমরা রামাদান মাসকে খাওয়ার মাস বানিয়ে ফেলেছি। বস্তুত, হিসাব হবে কি না তা চিন্তা না করে, সাওয়াব কিসে বেশি হবে তা চিন্তা করা দরকার। রামাদান মাস মূলত খাওয়ানোর মাস। দুভাবে খাওয়ানোর নির্দেশ রয়েছে হাদীসে। প্রথমত দরিদ্রদেরকে খাওয়ানো এবং দ্বিতীয়ত রোযাদারকে ইফতার খাওয়ানো। ইফতার করানোর বিষয়ে রাসূলুল্লাহ
বলেন:
مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ غَيْرَ أَنَّهُ لا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَيْئًا

“যদি কেউ কোনো রোযাদারকে ইফতার করায়, তাহলে সে উক্ত রোযাদারের সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে, তবে এতে উক্ত রোযাদারের সাওয়াব একটুও কমবে না।”

৬. ইফতার করানো অর্থ আনুষ্ঠানিকতা নয়। দরিদ্র সাহাবী-তাবিয়ীগণ নিজের ইফতার প্রতিবেশীকে দিতেন এবং প্রতিবেশীর ইফতার নিজে নিতেন। এতে প্রত্যেকেই ইফতার করানোর সাওয়াব পেলেন। অনেকে নিজের সামান্য ইফতারে একজন মেহমান নিয়ে বসতেন। আমাদের সকলেরই চেষ্টা করা দরকার নিয়মিত নিজেদের খাওয়া থেকে সামান্য কমিয়ে অন্যদেরকে ইফতার করানো। বিশেষত দরিদ্র, কর্মজীবি, রিকশাওয়ালা অনেকেই কষ্ট করে রোযা রাখেন এবং ইফতার করতেও কষ্ট হয়। সাধ্যমত নিজেদের খাওয়া একটু কমিয়ে এদেরকে খাওয়ানো দরকার।হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, রামাদান মাসে যারা সিয়াম পালন করেন তাদের দুটি শ্রেণী রয়েছে। এক শ্রেণীর পূর্ববর্তী সকল গোন্হা ক্ষমা করা হবে। অন্য শ্রেণী ক্ষুধা-পিপাসায় কষ্ট করা ছাড়া কিছুই লাভ হবে না। প্রথম শ্রেণীর রোযাদারদের বিষযে রাসূলুল্লাহ
বলেন:
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং আল্লাহর নিকট সাওয়াব অর্জনের খাঁটি নিয়্যাতে রামাদানের সিয়াম পালন করবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।”

৭. দ্বিতীয় শ্রেণীর রোযাদারদের বিষয়ে তিনি বলেন:
رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلاَّ الْجُوعُ وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلاَّ السَّهَرُ
“অনেক সিয়াম পালনকারী আছে যার সিয়াম থেকে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসা ছাড়া আর কোন লাভ হয় না। এবং অনেক কিয়ামকারী বা তারাবীহ-তাহাজ্জুদ পালনকারী আছে যাদের কিয়াম-তারাবীহ থেকে শুধু রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কোনোই লাভ হয় না।”

৮. এরূপ রোযাদারদের প্রতি বদদোয়া করে তাদের দুর্ভাগ্যের কথা জানিয়ে রাসূলুল্লাহ
বলেন:
بَعُدَ مَنْ أَدْرَكَ رَمَضَانَ فَلَمْ يُغْفَرْ لَهُ

“যে ব্যক্তি রামাদান মাস পেল, কিন্তু এই মাসে তাকে ক্ষমা করা হলো না সেই ব্যক্তি আল্লাহর রহমত থেকে চির-বঞ্চিত বিতাড়িত।”

৯. আমরা যারা রামাদানের সিয়াম পালন করতে যাচ্ছি তাদের একটু ভাবতে হবে, আমরা কোন্ দলে পড়ব। আর তা জানতে হলে রোযা বা সিয়ামের অর্থ বুঝতে হবে। রাসূলুল্লাহ
বলেন:
لَيْسَ الصِّيَامُ مِنَ الأَكْلِ وَالشُّرْبِ إِنَّمَا الصِّيَامُ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ

“পানাহার বর্জনের নাম সিয়াম নয়। সিয়াম হলো অনর্থক ও অশ্লীল কথা-কাজ বর্জন করা।”

১০. তাহলে চিন্তাহীন, অনুধাবনহীন, সৎকর্মহীন পানাহার বর্জন “উপবাস” বলে গণ্য হতে পারে তবে ইসলামী “সিয়াম” বলে গণ্য হবে না। হারাম বা মাকরূহ কাজেকর্মে রত থেকে হালাল খাদ্য ও পানীয় থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখার নাম সিয়াম নয়। সিয়াম অর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সকল হারাম, মাকরূহ ও পাপ বর্জন করার সাথে সাথে হালাল খাদ্য, পানীয় ও সম্ভোগ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এভাবে হৃদয়ে সার্বক্ষণিক আল্লাহ সচেতনতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে লক্ষ্য রেখে শত প্রলোভন ও আবেগ দমন করে সততা ও নিষ্ঠার পথে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য সিয়াম। যদি আপনি কঠিন ক্ষুধা বা পিপাসায় কাতর হয়েও আল্লাহর ভয়ে ও তাঁর সন্তুষ্টির আশায় নিজেকে খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত রাখেন, অথচ সামান্য রাগের জন্য গালি, ঝগড়া ইত্যাদি হারাম কাজে লিপ্ত হন, মিথ্যা অহংবোধকে সমুন্নত করতে পরনিন্দা, গীবত, চোগলখুরী ইত্যাদি ভয়ঙ্কর হারামে লিপ্ত হন, সামান্য লোভের জন্য মিথ্যা, ফাঁকি, সুদ, ঘুষ ও অন্যান্য যাবতীয় হারাম নির্বিচারে ভক্ষণ করেন, তাহলে আপনি নিশ্চিত জানুন যে, আপনি সিয়ামের নামে আত্মপ্রবঞ্চনার মধ্যে লিপ্ত আছেন। ধার্মিকতা ও ধর্ম পালনের মিথ্যা অনুভতি ছাড়া আপনার কিছুই লাভ হচ্ছে না। রাসলুল্লাহ
বলেছেন:
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ وَالْجَهْلَ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ

“যে ব্যক্তি পাপ, মিথ্যা বা অন্যায় কথা, অন্যায় কর্ম, ক্রোধ, মূর্খতাসুলভ ও অজ্ঞতামুলক কর্ম ত্যাগ করতে না পারবে, তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।”

১১. আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, তোমরা রোযার সময় দিবসে পানাহার করো না। এর পরের আয়াতেই আল্লাহ বললেন, তোমরা অপরের সম্পদ অবৈধভাবে “আহার” করো না। এখন আপনি প্রথম আয়াতটি মেনে দিবসে আপনার ঘরের খাবার আহার করলেন না, কিন্তু পরের আয়াতটি মানলেন না, সুদ, ঘুষ, জুলুম, চাঁদাবাজি, যৌতুক, মিথ্যা মামলা, যবর দখল, সরকারি সম্পত্তি অবৈধ দখল ইত্যাদি নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে অন্যের সম্পদ “আহার” করলেন, তাহলে আপনি কেমন রোযাদার?

একটি বিশেষ “আহার” হলো “গীবত”। “গীবত” শতভাগ সত্য কথা। যেমন লোকটি বদরাগী, লোভী, ঘুমকাতুরে, ঠিকমত জামাতে নামায পড়ে না, অমুক দোষ করে, কথার মধ্যে অমুক মুদ্রা দোষ আছে ইত্যাদি। এরূপ দোষগুলি যদি সত্যই তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবে তার অনুপস্থিতিতে তা অন্য কাউকে বলা বা আলোচনা করা “গীবত”। আল্লাহ বলেছেন, গীবত করা হলো মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়া। মৃতভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করার মতই “গীবত” করা সর্ববস্থায় হারাম। উপরন্তু সিয়ামরত অবস্থায় গীবত করলে “মাংস খাওয়ার” কারণে সিয়াম নষ্ট হবে বা সিয়ামের সাওয়াব সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে।

সিয়াম শুধু বর্জনের নাম নয়। সকল হারাম ও মাকরূহ বর্জনের সাথে সাথে সকল ফরয-ওয়াজিব ও যথাসম্ভব বেশি নফল মুস্তাহাব কর্ম করাই সিয়াম। বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় যে, রামাদান মাসে নফল-ফরয সকল ইবাদতের সাওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এজন্য সকল প্রকার ইবাদতই বেশি বেশি আদায় করা দরকার।

সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রামাদান মাসে উমরা আদায় করা রাসূলুল্লাহ-এর সাথে হজ্জ করার সমতুল্য। যদি কেউ রোযা অবস্থায় দরিদ্রকে খাবার দেয়, অসুস্থ মানুষকে দেখতে যায় এবং জানাযায় শরীক হয় তবে সে ব্যক্তিকে আল্লাহ জান্নাত দান করবেন। এ ছাড়া হাদীসে রামাদানে বেশি বেশি তাসবীহ, তাহলীল, দুআ ও ইসতিগফারের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ বলেছেন যে, রোযা অবস্থার দুআ ও ইফতারের সময়ের দুআ আল্লাহ কবুল করেন। বিশেষভাবে দু প্রকারের ইবাদত রামাদানে বেশি করে পালন করতে হাদীসে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, দান। “সাদকা” বা দান আল্লাহ তাআলার প্রিয়তম ইবাদত।

রমযানে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীঃ

বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদের (সা.) জীবদ্দশায় ও রমজান মাসে বিভিন্ন অবিস্মরণীয় ঘটনাবলী সংঘটিত হয়। তার মধ্য থেকে কয়েকটি ঘটনার আলোকপাত করা হলো।

এক. নবুওয়াতের প্রথম বছর রমজান মাসে হেরা গুহায় পবিত্র কোরআন শরীফ অবতীর্ণ হয়।
দুই. নবুওয়াতের ষষ্ঠ বছর রমজান মাসে হজরত উমর (রা.) এবং হজরত হামজা (রা.) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
তিন. নবুওয়াতের দশম বছর রমজান মাসে রাসুলের (দ.) চাচা আবু তালিব এবং খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করেন।
চার. দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রামাদানুল মুবারকে ইসলামের প্রথম জিহাদ ঐতিহাসিক ‘গাজওয়ায়ে বদর’ সংঘটিত হয়।
পাঁচ. পঞ্চম হিজরির রামাদান মাসে খন্দকের যুদ্ধ হয়।
ছয়. অষ্টম হিজরির ১০ রামাদান জুমার দিনে মক্কা বিজয় হয়।
সাত. অষ্টম হিজরির ১৬ রামাদান কিয়ামত পর্যন্ত সুদকে হারাম করা হয়।
আট. নবম হিজরির রামাদান মাসে তাবুকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
নয়. এগারো হিজরির রামাদান মাসে ফাতিমা (রা.) ইন্তেকাল করেন।
দশ. আটান্ন হিজরির মাহে রামাদানে হজরত আয়েশা (রা.) ইন্তেকাল করেন।

পবিত্র রামাদানুল মোবারক যেমন কোরআন নাযিলের মাস, তেমনি তা কোরআন বিজয়েরও মাস। কোরআনের আদেশ নিষেধ তথা ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য পবিত্র রামাদান মাসেই গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ বা বিপ্লবগুলো সংঘটিত হয়েছিল। রামাদান হলো শক্তি ও বিজয়ের প্রতীকি মাস। রামাদানের বরকত এবং আল্লাহর রহমতেই মুসলমানরা সেগুলোতে বিজয় লাভ করেছিল। মুসলমানরা এ মাসে এত বেশি বিজয় লাভ করেছে যা অন্য মাসে সম্ভব হয়নি। এই মাসে একটি জিহাদও নেই যে জিহাদে মুসলমানরা পরাজিত হয়েছে। ইসলামের ১ম যুদ্ধ ও বিজয় বদরের প্রান্তরে কিন্তু ১৭ই রামাদানে সংঘঠিত হয়েছিল। ষষ্ঠ হিজরীর রামাদান মাসে মুসলমানরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুজাহিদ বাহিনীকে বিভিন্ন অভিযানে পাঠায়। তাদের মধ্যে ওক্কাসা বিন মাসফি ও আবু উবায়দা বিন জাররাহর নেতৃত্বে দুটো দল দুটো অভিযানে যায়। যায়েদ বিন হারিসার নেতৃত্বাধীন দলটি খন্দক যুদ্ধে কুরাইশদের সাথে অংশগ্রহণকারী বনী ফোজারার সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। সপ্ত হিজরীর রমযান মাসে গালিবের নেতৃত্বে ১৩০ জন মুজাহিদ বনী আবদ বিন ছাবিলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বের হয়। তারা প্রকাশ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করে, যার ফলে যুদ্ধ শুরু হয় এবং হযরত গালিবের বাহিনী জয়লাভ করে।

রাসূলে করিম (দঃ) এর ওফাতের পর দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) এর শাসনামলে ১৫ হিজরীর ১৩ই রামাদান আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ (রাঃ) জেরুজালেম জয় করেন। কাদিসিয়ার ময়দানে পারস্য সম্রাট ইয়াজদাগদের প্রধান সেনাপতি রুস্তমের সাথে ১৫ হিজরীর রামাদান মাসে মোকাবেলা হয়। তাতে রুস্তম পরাজিত হয় এবং মুসলিম বাহিনী জয়লাভ করে। মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্র স্থান বায়তুল মুকাদ্দাসও এই পবিত্র রমযান মাসে জয় করা হয়।

তদানীন্তন পরাশক্তি রোমান সাম্রাজ্য ইসলামকে উৎখাত করার বহু চেষ্টা চালায়। হযরত আমর বিন আস (রাঃ) ২০ হিজরীর ২রা রমজান ব্যাবিলন দুর্গ অবরোধ করার পথে রোমান বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন। উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদের আমলে তার সেনাধ্যক্ষ মূসা বিন নুসাইর ৯১ হিজরীর ১লা রামাদান তোয়াফ স্পেনের রাস্তা আবিস্কারের জন্য পাঠান। তারপর ৯২ হিজরীর রমজানে তাকে বিন যিয়াদের হাতে স্পেন জয় হয়। ৯৩ হিজরীর ৯ই রমজান মুসা বিন নুসাইর স্পেনে পরিপূর্ণ বিজয় লাভের জন্য আক্রমন চালান এবং বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন। ৯৬ হিজরীর রামাদান মাসে মোহাম্মদ বিন কাসিমের হাতে অত্যাচারী সিন্ধু রাজা দাহির পরাজিত হয়। ২১২ হিজরীর রামাদান মাসে জিয়াদ বিন আগলাকের হাতে ইতালির ’সিসিলি’ দ্বীপ জয় হয়।

রামাদানের ৩০টি পালনীয় আমলঃ

১. সিয়াম পালন করা
২. সময় মত সালাত আদায় করা
৩. সহীহভাবে কুরআন শেখা
৪. অপরকে কুরআন পড়া শেখানো
৫. সাহরী খাওয়া
৬. সালাতুত তারাবীহ পড়া
৭. বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা
৮. শুকরিয়া আদায় করা
৯. কল্যাণকর কাজ বেশি বেশি করা
১০. সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়া
১১. বেশি বেশি দান-সদাকাহ করা
১২. উত্তম চরিত্র গঠনের অনুশীলন
১৩. ই‘তিকাফ করা
১৪. দাওয়াতে দ্বীনের কাজ করা
১৫. সামর্থ্য থাকলে উমরা পালন করা
১৬. লাইলাতুল কদর তালাশ করা
১৭. বেশি বেশি দো‘আ ও কান্নাকাটি করা
১৮. ইফতার করা
১৯. ইফতার করানো
২০. তাওবা করা
২১. তাকওয়া অর্জন করা:
২২. ফজরের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করা
২৩. ফিতরাহ দেয়া
২৪. অপরকে খাদ্য খাওয়ানো
২৫. আত্মীয়তার সম্পর্ক উন্নীত
২৬. কুরআন মুখস্থ বা হিফয করা:
২৭. আল্লাহর যিকর করা
২৮. মিসওয়াক করা
২৯. একজন অপরজনকে কুরআন শুনানো ও
৩০. কুরআন বুঝা ও আমল করা।

রামাদানে বর্জনীয় আমলঃ

১. বিলম্বে ইফতার করা
২. সাহরী না খাওয়া
৩. শেষের দশ দিন কেনা কাটায় ব্যস্ত থাকা
৪. মিথ্যা বলা ও অন্যান্য পাপ কাজ করা
৫. অপচয় ও অপব্যয় করা
৬. তিলাওয়াতের হক আদায় না করে কুরআন খতম করা
৭. জামা‘আতের সাথে ফরয সালাত আদায়ে অলসতা করা
৮. বেশি বেশি খাওয়া
৯. রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদাত করা
১০. বেশি বেশি ঘুমানো
১১. সংকট তৈরি করা জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধির জন্য
১২. অশ্লীল ছবি, নাটক দেখা
১৩. বেহুদা কাজে রাত জাগরণ করা
১৪. বিদ‘আত করা ও
১৫. দুনিয়াবী ব্যস্ততায় মগ্ন থাকা।

মহান রবের নিকট সবার বিনীত প্রার্থনা পবিত্র রামাদান ও জুমা মোবারকের বরকতে উসিলায় বিশ্বের সকল মানুষের উপর হতে করোনার ভয়াল কঠিন পরিস্থিতি হতে পরিত্রাণ দান। নির্যাতিত সকল মুসলমানে শান্তি ও কামনা হোক আজকের দোয়া ও মোনাজাত। আমিন।

মাওলানা মোঃ রাহাত উল্লাহ
সহকারী শিক্ষক
উত্তর রাঙ্গুনিয়া উচ্চ বিদ্যালয়
[email protected]

Check Also

ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা

ইসরাইলে হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানের ড্রোন কর্মসূচির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। বৃহস্পতিবার একযোগে এ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

x