ইমাম মেহেদী:
২০২০ সাল মুজিববর্ষ ও ২০২১সাল স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী হিসেবে পালিত হয়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। কারণ ১৯২০ সালে টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন হাজার বছরের বাঙালির পুরুষোত্তম ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। কালের বিবর্তণে শতবর্ষে আজও বঙ্গবন্ধু আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এবং প্রাসঙ্গিক।
হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালির অধিকার আদায়, মুক্তির আন্দোলন, ভাষা ও স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন বহু প্রতিথযশা রাজনৈতিক নেতা এবং বিপ্লবী পুরুষ। কিন্তু স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিকাশ ও বিজয়ের স্বাদ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অভিন্ন দুটি শব্দ। যে শব্দ দুটি বাঙালির নিজস্ব স্বকীয়তার স্থাপত্যর নিদর্শন। একই বিনি সুতোয় গাঁথা। যে শব্দ দুটি বিশ^ মানচিত্রে বাঙালির প্রতিনিধিত্ব করে একটি স্বাধীনতার পতাকার মাধ্যমে।
মেধা, মনন, প্রজ্ঞা, ভালোবাসার অদম্য সমাহর নিয়ে হাজার বছরের বাঙালি ও বাংলার ইতিাহসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেছেন অবিসংবাদিত নেতা। যুগে যুগে আমরা বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে ধারণ ও স্মরণ করে আসছি। যা বিশে^র ইতিহাসে অন্যতম। আমাদের এই বাংলা ভূখন্ড যুগে যুগে বিভিন্ন শাসকগোষ্টী দ্বারা শাষিত ও শোষিত হয়েছে। আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই শোষিত মানুষের নেতা। বঙ্গবন্ধু ধর্মগতভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান ছিলেন না। ছিলেন মুসলমান। সবার কাছে তার সব থেকে বড় পরিচয় তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি। বঙ্গন্ধুর চিন্তা-চেতনা ছিলো অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন। যেখানে বহুধর্মের মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করবে। সেই বাংলাদেদেশর জন্যই তিনি আজীবন রাজনীতি করেছেন এবং স¦প্ন দেখেছে যে রাজনীতির হাতেখড়ি নিয়েছেন তিনি কিশোর বয়স থেকেই।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পরও আমরা স্বাধীন হতে পারিনি। পরবর্তীতে ‘ইস্টবেঙ্গল’ এর পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তান আমাদেরকে চাপিয়ে দিয়ে ‘ ইস্ট পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তান’ নাম করণ করেছে।
১৯৬৯ সালে ৫ ডিসেম্বর গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদীর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবাষির্কীতে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে আমাদের এই মানচিত্রকে প্রথমবারের মত নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। তার আগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত হয়েছে আমাদের এই অঞ্চল। কখনো বা আবার আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বঙ্গ, বঙ্গদেশ, বাংলা, পূর্ববাংলা, ইস্ট বেঙ্গলসহ অনেক নামেই নামকরণ হয়েছে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই ‘বাংলাদেশ’ একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মধ্যে দিয়ে বিশে^র মাঝে হাজার বছরের মানচিত্রে ঠাঁই করে নিয়েছে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সরকার গঠন ও ১৭ এপ্রিল শপথ অনুষ্ঠানও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ নামে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর যখন প্রথম সংবিধানে প্রণীত ও গৃহীত হয় সেই সময় সাংবিধানিকভাবে নাম দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ‘বাংলাদেশ’। সুতরাং বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক। বাংলাদেশকে চিনতে হলে বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে। এবারে আসি বঙ্গবন্ধুকে আমরা কতোভাবে ধারণ ও স্মরণ করি তা নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনায়।
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ। সেই থেকে তিনি আমাদের ‘বঙ্গবন্ধু’। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তৎকালীন ডাকসু ছাত্রনেতা আ.স.ম. আব্দুর রব বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির জনক’ উপাধিতে ভূষিত করার মধ্য দিয়ে হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন ‘জাতির জনক’। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানেও শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির জনক’ হিসেবে ঘোষণা করে।
১৯৭১ সালের সাত মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসকি ভাষণ এখন বিশ্বের সেরা ভাষণের একটি। যে ভাষণ বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার জন্য। সেই ভাষণ এখনও বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্পদ। ইতিহাস ঐতিহ্যবাহী ভাষণের প্রসঙ্গ আসলেই বঙ্গবন্ধুর নাম চলে আসে।
অন্যদিকে একাত্তর সালের ৫ এপ্রিল ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’ এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে অখ্যায়িত করেন সাংবাদিক লোরেন জেঙ্কিস। সেই থেকে তিনি বিশে^র মাঝে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে পরিচিত।
একাত্তর সালের ১৭ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদনাথ তলার নামকরণ করেন মুজিবনগর। সেই থেকে মুজিবনগর। এমনকি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ খাতাকলমে থাকলেও তার সাথে হাজার বছরের ইতিহাসে সেই সরকার হয়ে গেলো মুজিবনগর সরকার। পরবর্তীতে মুজিবনগর উপজেলায় রপান্তরিত হয়েছে এবং সেখানে মুজিবনগর সরকারি ডিগ্রি কলেজসহ বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চারনেতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত নান্দনিক নিদর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিভিন্ন স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা এখন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাত মার্চের ভাষণ তাঁর আদলে দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং শেখানো ও শোনানো হয়। যার মাধ্যমে একটি জাতির নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের প্রকৃত বার্তার চিত্র ফুটে ওঠে। যুগ যুগ ধরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দেশে বিদেশে গান, কবিতা, সিনেমা, ডকুমেন্টরিও রচিত হয়েছে। যেগুলো বাঙালি হৃদয়ে ধারণ করে আসছে বহুবছর ধরে। এমনকি বাঙালি ‘মুজিব কোট’ এর মত পোশাকের মাধ্যমেও বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। দেশ বিদেশে বহু ধরণের কোর্ট পাওয়া যায় কিন্তু তার মধ্যে ‘মুজিব কোট’ অন্যতম চেতনা বহন করে। যার সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস মিশ্রিত। শেখ মুজিব তার রাজনৈতিক প্রচারণায় যে কোটি পরতেন তাকে বাংলাদেশে ‘মুজিব কোট’ নামে ডাকা হয়।
তাছাড়াও মিয়া ভাই, মুজিব ভাই, শেখ সাহেব এই শব্দগুলিও আজ বিশেষভাবে সংরক্ষিত হয়েছে মর্যাদার সহিত শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্য। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে অনেকই মুজিব ভাই, শেখ সাহেব কিংবা মিয়া ভাই ডাকতেন। তাছাড়াও ‘আমার বাঙালি, বাংলার মানুষ, মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা ইত্যাদি শব্দগুলোর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু এককভাবে।
অন্যদিকে ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) চতুর্থ সম্মেলনে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। সেই সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সাক্ষাৎ হলে তিনি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়েজ। বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব। ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইজ দ্য হিমালয়েজ। আই হ্যাভ দাজ হ্যাড দ্য এক্সপিরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়েজ।’
অর্থাৎ, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।’ সেই থেকে বঙ্গবন্ধু হিমালয় নামেও পরিচিতি পেলেন।
২০০৩ সালে, ফ্রন্টলাইন সাময়িকীর একটি প্রবন্ধে লেখক ডেভিড লুডেন তাকে একজন ‘ফরগটেন হিরো’ বা ‘বিস্মৃত বীর’ বলে উল্লেখ করেন।
১৪ এপ্রিল ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা সার্ভিসের শ্রোতা জরিপে বঙ্গবন্ধুকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে ঘোষণা করেন। বিবিসির পক্ষ থেকে ২০ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়। তারমধ্যে একনম্বর তালিকায় বঙ্গবন্ধু।
২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর, ইউনেস্কো শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর মাধ্যমে বিশে^র ইতিহাসে নতুনভাবে চেনা জানার সুযোগ হল বঙ্গবন্ধুকে। ২০১৭ সালে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির একটি সড়কের নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মাগর্’ নামকরণ করা হয়। তার আগেও কলকাতাতে একটি সড়কের নামকরণ রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামে।
অন্যদিকে ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ব বন্ধু’ (ফ্রেন্ড অব দ্যা ওয়ার্ল্ড) হিসেবে আখ্যা দেয়। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু ‘বিশ্ববন্ধু’ নামেও মানুষের মাঝে ছড়িয়ে গেলেন।
বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যমন্ডিত। বঙ্গবন্ধু যুগে যুগে তাঁর সৃষ্টি-কৃষ্টি দিয়ে হয়ে উঠেছেন বাংলার মানুষের কাছে হাজার বছরের পুরুষোত্তম। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি ছড়িয়ে গেছেন এবং আছেন বিশে^র বহুকোটি মানুষের হৃদয়ে বহুমাত্রিকভাবে। যে বহুমাত্রায় আমরা তাঁকে স্মরণ করে যাবো মন ও মননে আগামী হাজার বছর ধরে ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের সেই ১৪০০ সালের কবিতার ভাষায়- আজি হতে শতবর্ষ পরে / কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি/ কৌতূহলভরে/ আজি হতে শতবর্ষ পরে ।
ইমাম মেহেদী
গবেষক ও কর্মকর্তা
রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ^বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
ই-মেইল: emam.mehedi@gmail.com