সব দেশেই সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য জাতীয় বাজেটে কর রাজস্ব তথা আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, শুল্ক ইত্যাদি এবং করবহির্ভূত রাজস্ব তথা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মুনাফা ও সরকারি সেবা ফি ইত্যাদি ধার্য করা হয়। কিন্তু এই দুই উৎস থেকে যে পরিমাণ অর্থ আসে তা এক বছর সরকার পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই বাংলাদেশের মতো অনেক দেশেই সরকার পরিচালনার জন্য বাজেট ঘাটতি দেখা যায়। এই ঘাটতি পূরণে সরকারকে ঋণ ও অনুদান নিতে হয়।
এর একটি উৎস হলো ব্যাংকঋণ, যা নিয়ে থাকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশই। অন্য উৎসগুলো হচ্ছে—সঞ্চয়পত্র, বৈদেশিক ঋণ, অনুদান ইত্যাদি। সরকারের ঋণ গ্রহণ একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু ঋণ গ্রহণের মাত্রা এবং এর ব্যবহার যদি সঠিক না হয়, তাহলে বিষয়টি আর স্বাভাবিক থাকে না। তাতে সরকার ও জনগণকে নানামুখী সংকটের মধ্যে পড়তে হয়।
সাম্প্রতিককালে আমরা দেখছি, ব্যাংকিং খাত থেকে বাংলাদেশ সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। যেমন চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৩৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল অনেক কম, প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। তার মানে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারের ঋণ বেড়েছে এবং এই ঋণটা বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৪৫ শতাংশ। আবার চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে এবং সেটা লক্ষ্যমাত্রার ৩৮ শতাংশ। রাজস্ব আয় ভালো হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকঋণ বাড়ার অর্থ হচ্ছে রাজস্ব আয়টি সরকারের ঘাটতি মেটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবে ব্যাংকঋণ বাড়লেও দেশে বৈদেশিক ঋণের প্রবাহ বেশ কম। আবার রাজস্ব আয়ে অন্য খাতগুলো যে অবদান রাখার কথা সেটাও পূরণ হচ্ছে না।
এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার যদি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, তাহলে সেটা ব্যক্তি খাতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কি না। তাত্ত্বিকভাবে বলা যায়, সরকার যখন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, তখন ব্যক্তি খাতে ঋণের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করে। মানে বিভিন্ন ব্যাংকের তারল্যের একটা বড় অংশ যখন সরকারের কাছে ঋণ হিসেবে চলে যায় তখন ব্যক্তি খাতে ঋণ কমে যায়। এটাকে বলে ক্রাউডিং আউট ইফেক্ট। এর অর্থ হচ্ছে, সরকার যখন দেশের ঋণের বাজারে প্রবেশ করে, তখন ক্রাউডিং আউটের ফলে ব্যক্তি খাত ঋণ কম পায়। এর সঙ্গে সঙ্গে সুদের হারও বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হচ্ছে, আমাদের ব্যাংকঋণের বর্তমান তারল্য মোটামুটি সন্তোষজনক। এই মুহূর্তে আমাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে চাহিদা তা বেশির ভাগই বড় শিল্প বা বাণিজ্য থেকে আসছে। ছোট ও মাঝারি শিল্পে চাহিদা থাকলেও সেখানে বিতরণ প্রবণতা কম।
অন্যদিকে কভিড-১৯ থেকে অর্থনৈতিক উত্তরণের জন্য সরকারের ২০২০ সালের প্যাকেজের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ অনুপাত) কমিয়েছে, এসএলআরের (বিধিবদ্ধ আমানত জমা রাখা) পরিমাণ কমিয়েছে এবং রেপো রেট (আর্থিক খাতকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ প্রদান) কমিয়েছে ও রিভার্স রেপো রেটও (অর্থ উঠিয়ে নেওয়ার হার) কমিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থের সরবরাহ বৃদ্ধি করেছে। সে জন্যই ক্রাউডিং আউট ইফেক্টটা এখনো বেশি অনুভূত হচ্ছে না। তবে বর্তমান অবস্থা থেকে যদি সরকারের ঋণ বাড়তে থাকে, তাহলে এ ক্ষেত্রে একটা প্রভাব আসতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, আমাদের চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বৈদেশিক ঋণ এসেছে মাত্র ২ শতাংশ। মানে খুব একটা আসেনি। তাই সরকার দিন দিন অভ্যন্তরীণ উৎসর ওপরই বেশি নির্ভর করছে। বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে প্রায় এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৬ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক খাত থেকে নেওয়ার কথা। কিন্তু এরই মধ্যে সরকার ৩৪ হাজার কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ৪৫ শতাংশ ঋণ নিয়ে ফেলেছে। সরকারের ব্যাংকবহির্ভূত ঋণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে প্রায় ৩৭ হাজার এক কোটি টাকা, যার মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়ার কথা ৩২ হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রেও সরকার এরই মধ্যে ১৪ হাজার কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ৪৬ শতাংশ ঋণ নিয়েছে।
এর মধ্য দিয়ে একটা জিনিস পরিষ্কার যে সরকারের ঋণের বোঝা আস্তে আস্তে বাড়ছে এবং এই খাতে ভবিষ্যৎ ঋণের সুদ বাবদ ব্যয়ও বাড়ছে। অর্থাৎ ঋণের সুদ বাবদ সরকারের যে প্রদেয়, বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ ঋণের জন্য, সেটার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। একটা হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের দেশি-বিদেশি মোট ঋণ জিডিপির প্রায় ৩৪ শতাংশ। কিন্তু সুদসহ ধরলে সেটা ৪১ শতাংশ। তবে আমি এটাকে মোটামুটি সহনশীল বলতে চাই, আমাদের দেশের আর্থিক সক্ষমতা ও অন্যান্য দেশের তুলনামূলক বিচারে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রেক্ষাপটও দেখা যেতে পারে। ভারত সরকারের মোট ঋণ তার জিডিপির ৫০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণ তাদের জিডিপির প্রায় ৯৮ শতাংশ। যুক্তরাজ্যের আরো বেশি ১১৫ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরের ১০৯ শতাংশ। সিঙ্গাপুরকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিতে হয় এবং তারা দ্রুত শোধ করে। তাদের সক্ষমতাটা এমনই। সক্ষমতার প্রশ্নটি এ কারণেই আসে যে আমরা যেন ঋণের ওপর বেশি নির্ভর না করি। আমাদের বরং আওতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করে রাজস্ব আয় বাড়ানোর দিকেই অনেক বেশি মনোনিবেশ করা উচিত। সরকারের সংস্থার মুনাফা বা লভ্যাংশ এবং দিন দিন বিস্তৃত হওয়া সরকারি সেবার বিপরীতে যথাযথভাবে ফি আদায় করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো আমাদের বিমান, রেলওয়ে, পেট্রোলিয়াম করপোরেশনসহ অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আসা দূরের কথা, বরং সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়। যেহেতু আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারছি না, তাই আমাদের সরকারি ঋণের পরিমাণটা জিডিপির ৩৪ শতাংশ থেকে চট করে বাড়তে দেওয়া উচিত হবে না। তবে বিদেশি ঋণের স্থিতি আমাদের জিডিপির সব মিলিয়ে ১২ শতাংশের মতো এবং এর সুদের পেছনে বার্ষিক ব্যয় হয় জিডিপির ১ শতাংশ।
এই পরিপ্রেক্ষিতে এখন আমরা ঋণ আরো নেব কি না, নিলে কোথা থেকে নেব—এই প্রশ্নটা স্বভাবতই চলে আসে। তবে আমি মনে করি, যেহেতু এই মুহূর্তে ব্যাংকের তারল্য সংকট নেই, তাই স্বল্প মেয়াদে এখন ঋণ নিতে অসুবিধা নেই। কিন্তু যতটা সম্ভব কমানো উচিত। সঞ্চয়পত্রে সুদহার হ্রাস ও বিধি-নিষেধ আরোপ করায় এরই মধ্যে এ উৎস থেকে সরকারের ঋণ কমে আসবে বলেই মনে করা হয়। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের জন্য সঞ্চয়পত্রের সুদের হার থেকে কম সুদ দিতে হয়। আপাতদৃষ্টিতে এটা সরকারের জন্য গ্রহণযোগ্য মনে হলেও সার্বিক বিবেচনায় ব্যাংকের ওপর সরকারের অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়া ঠিক হবে না। তৃতীয় উৎস হলো বৈদেশিক ঋণ। এ ক্ষেত্রে মূল্যায়নটা হচ্ছে, বৈদেশিক ঋণ এখন পর্যন্ত যে পরিমাণে আছে তা বেশি নয়। এখন পর্যন্ত আমাদের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি হলো ১২.৫ শতাংশ। সে তুলনায় আমরা একটা মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে আছি। এখন যদি আমরা সহজ শর্তে বৈদেশিক ঋণ পাই, তাহলে সেটা বিবেচনা করা উচিত।
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটা বিষয় আসে। সেটা হচ্ছে আমাদের দেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ হলো জিডিপির ২৯ শতাংশ। কিন্তু আমরা যদি আমাদের প্রবৃদ্ধিকে ৮ শতাংশে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়িয়ে জিডিপির ৩৪ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের মোট বিনিয়োগের একটা অংশ সরকারি খাতে। অতএব, প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য আমাদের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআর) বা বৈদেশিক পোর্টফোলিও বিনিয়োগ (এফপিআই), অথবা বিদেশি আর্থিক অনুদান নিতে হবে। আর ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো গতিশীল করতে হবে।
যেহেতু বড় ধরনের সমস্যা ছাড়াই সরকারের ব্যাংকঋণের পরিমাণ বাড়ানো যৌক্তিকতা ও সুযোগ আছে, তাই সরকার চাইলে সেটা কিছু পরিমাণে বাড়াতেই পারে। তবে একই সঙ্গে লক্ষ রাখতে হবে যে এটা যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়। অর্থাৎ সক্ষমতার বাইরে ঋণ নেওয়া যাবে না। আমরা এখনই দেখছি যে বর্তমান অর্থবছরে (২০২১-২২) ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ বাজেটের ১১ শতাংশের মতো অর্থ বরাদ্দ করতে হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সেটা ছিল ৬ শতাংশ। তার মানে সুদ পরিশোধ বাবদ বাজেট বরাদ্দ ৫ শতাংশ বেড়েছে। যেহেতু বাজেটের বড় অংশ সুদ পরিশোধ বাবদ খরচ করতে হয়, তাই সেটা বিবেচনা করে সরকারকে ঋণ নিতে হবে।
ঋণের প্রধান প্রত্যাশা হলো, এই অর্থ যেন যথাযথ ব্যবহার করা হয়। না হলে সেটা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমাদের যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, সেগুলোর জন-উপযোগিতা যাচাই করতে হবে। বিশাল অঙ্কের ঘাটতি পূরণের জন্য বেশি প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্পের সময় ক্ষেপণ করার মতো অবস্থা আমাদের নেই। অথচ এটাই হচ্ছে বেশি। আমাদের অবশ্যই বড় বড় প্রকল্পের প্রয়োজন আছে। কিন্তু যথাসময়ে ঋণের অর্থ ব্যবহার না করলে তা জনগণের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, প্রত্যক্ষভাবে দেশের মুদ্রাবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং শেষমেশ ব্যক্তি খাতের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সুতরাং সব কিছু মিলিয়ে এটাই বলা যায়, আমাদের সরকারি ঋণব্যবস্থাকে আরো সুষ্ঠু, কার্যকর ও যৌক্তিক করতে হবে।
লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়