দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণের দিন এসে গেছে। ফেরি, লঞ্চ, স্পিড বোট কিংবা ট্রলারে চড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মা পাড়ি দেওয়ার দিন শেষ হচ্ছে। স্বপ্নের সেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে ভোগান্তি ছাড়াই দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ পাড়ি দেবে পদ্মা। এতে সময়ও বাঁচবে আগের তুলনায় অর্ধেকেরও বেশি। স্বপ্নসেতুকে ঘিরে জল্পনা-কল্পনার অভাব নেই পদ্মাপাড়ের মানুষের।
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হতে চলেছে শনিবার (২৫ জুন)। উদ্বোধনকে ঘিরে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠান হবে সেতুর দুইপ্রান্তেই। এরই মধ্যে জাঁকজমকভাবে সাজানো হয়েছে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্ত। উভয়প্রান্তেই নির্মাণ করা হয়েছে ৪০ ফুট উচ্চতার দুটি ম্যুরাল। দুটি ম্যুরালে রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি। এর পাশে নির্মাণ করা হয়েছে উদ্বোধনী ফলক।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত থেকে সেতু উদ্বোধন করে সুধী সমাবেশে অংশ নেবেন। এরপর গাড়িতে চড়ে সেতু পার হয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে আরেকটি উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন।
বাংলাবাজার ঘাটের তিন কিলোমিটার জুড়ে আলোকসজ্জা করা হয়েছে ইতোমধ্যে। এছাড়া ওই অঞ্চলের জেলাগুলোতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ব্যানার, ফেস্টুন করেছেন এবং রাস্তার উপরে তোরণ নির্মাণ করেছেন। প্রায় দশ লাখ লোকের জনসমাগম হবে বলে আশা করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। লোকসমাগম বাড়াতে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিরা। পদ্মা সেতু নির্মান করা চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে সেতুটি বুঝিয়ে দিয়েছেন।
বাংলাবাজার ঘাটে জনসভার মঞ্চ করা হয়েছে পদ্মা সেতুর আদলে। এগারোটি পিলারের ওপর দশটি স্প্যান বসিয়ে পদ্মা সেতুর আদলেই ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪০ ফুট প্রস্থের বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। মঞ্চের ঠিক সামনে পানিতে ভাসমান বিশাল আকৃতির একটি নৌকা। দেখে মনে হবে পদ্মা সেতুর পাশ দিয়ে বড় একটি নৌকা চলছে। নিরাপত্তার জন্য মঞ্চের ভেতরে ও বাইরে বসানো হয়েছে ছয়টি ওয়াচ টাওয়ার। থাকবে দেড় শতাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা। র্যাব, পুলিশ, সেনা সদস্য, এসএসএফসহ নানা বাহিনীও তৎপর। এটি ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে রূপ নেবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। স্বপ্নের সেতুর উদ্বোধনী মঞ্চে থাকবেন ৪১ জন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও মঞ্চে থাকবেন আওয়ামী লীগের পাঁচজন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের ২১ জন নেতা। বাকি ১৫ জন মন্ত্রিসভার সদস্য, দলীয় এমপি এবং দক্ষিণাঞ্চলের জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মাওয়া প্রান্তের সুধী সমাবেশে অংশগ্রহণের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে দেশের রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে।
সমাবেশটিকে ঐতিহাসিক সমাবেশ করার লক্ষ্যে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। দক্ষিণের ২১ জেলা থেকে নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে আসবেন। প্রায় দশ লাখ লোকের জনসমাগম হবে বলে ধারণা করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে থাকবে একটি একক রেলপথ।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতু নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর ২০১৭ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুতে বসে প্রথম স্প্যান। সেই থেকে তিন বছর দুই মাস ১০ দিনে বা মোট ১১৬৭ দিন পর ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর সেতুর সব স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পুরো পদ্মা সেতু। তিন হাজার ৬০০ টন ধারণ ক্ষমতার ‘তিয়ান-ই’ ভাসমান ক্রেন দিয়ে স্প্যানগুলো বসানো হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রয়োজন হয় দুই হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে র্যাব।
দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার সেই সোনালী অধ্যায় শুরুর অপেক্ষায় এখন পুরো জাতি।
শত দুর্ভোগ, আর ভোগান্তির দিন শেষ হচ্ছে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের। পদ্মার বুকে দৃশ্যমান এই পদ্মাসেতুর দ্বার খুলতে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য। আর তাতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে পদ্মার দুই পাড়ের মানুষেরা।
একনজরে পদ্মা সেতু
প্রকল্পের নাম: পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প।
প্রকল্পের অবস্থান: রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে।
যেভাবে শুরু: ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়। এরপর ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই হয়। ২০০৪ সালের জুলাই মাসে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সুপারিশ মেনে মাওয়া-জাজিরার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করে। মহাজোট সরকার শপথ নিয়েই তাদের নিয়োগ দেয়। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু করার চূড়ান্ত নকশা করা হয়।
একনেক সভায় অনুমোদন: ২০০৭ সালে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন পায়। পরে নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয়ও বাড়ে। ২০১১ সালে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার সংশোধিত প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে আবারও আট হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ালে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সবশেষ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর পুরো টাকাই সরকারি অর্থায়ন।
প্রকল্পের মেয়াদ: ১ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৩০ জুন ২০২৩।
প্রকল্পের মোট ব্যয়: ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।
মূল সেতুর ঠিকাদার: পদ্মা সেতু নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ কোম্পানির নাম চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের আওতাধীন চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি।
মূল চুক্তিমূল্য: ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
কাজ শুরু: ২৬ নভেম্বর, ২০১৪।
চুক্তি অনুযায়ী কাজ সমাপ্তির তারিখ: ২৫ নভেম্বর, ২০১৮। পরে কয়েক ধাপে সময় বাড়ানো হয়।
কাজের মূল সময়সীমা: ৪৮ মাস। বর্ধিত সময় ৪৩ মাস।
কাজ সমাপ্তির পুনঃনির্ধারিত তারিখ: ৩০ জুন, ২০২২ (বর্ধিত সময়সহ)।
রেল সংযোগ: পদ্মা সেতুতে রেললাইন স্থাপন হচ্ছে স্প্যানের মধ্য দিয়ে।
অফিসিয়াল নাম: পদ্মা সেতু।
নকশা: আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএমের (AECOM) নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল।
ধরন: পদ্মা সেতুর ধরন দ্বিতলবিশিষ্ট।
প্রধান উপকরণ: কংক্রিট ও স্টিল।
রক্ষণাবেক্ষণ: বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ।
দৈর্ঘ্য: পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার।
প্রস্থ: পদ্মা সেতুর প্রস্থ হবে ৭২ ফুট, এতে থাকবে চার লেনের সড়ক। মাঝখানে রোড ডিভাইডার।
ভায়াডাক্ট: পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ১৮ কিলোমিটার।
ভায়াডাক্ট পিলার: ৮১টি।
পানির স্তর থেকে উচ্চতা: ৬০ ফুট।
পাইলিং গভীরতা: ৩৮৩ ফুট।
মোট পিলার: ৪২টি।
মোট পাইলিং: ২৮৬টি।
সংযোগ সড়ক: পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক দুই প্রান্তে (জাজিরা ও মাওয়া) ১৪ কিলোমিটার।
মোট লোকবল: পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করছে প্রায় চার হাজার মানুষ।
প্রবৃদ্ধি বাড়বে: ১ দশমিক ২ শতাংশ।
নদীশাসন: প্রকল্প এলাকায় প্রায় ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন করতে হয়েছে। এর মধ্যে মাওয়া এলাকায় ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং বাকি ১২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার জাজিরা এলাকায়।
ঠিকাদারের নাম: সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড চায়না।
চুক্তিমূল্য: ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
ভূমি অধিগ্রহণ: ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ২ হাজার ৬৯৩ দশমিক ২১ হেক্টর।
অ্যাপ্রোচ রোড: জাজিরা ও মাওয়া।
সেতু পাড়ে বৃক্ষরোপণ: লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৪ লক্ষাধিক।
পূর্বপশ্চিম