কয়েকটি গুলি ছুড়ে চোখের পলকে হত্যা করা হয় মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে। একই সময়ে হত্যাকারীর ছোড়া এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন টিপুর গাড়ির ঠিক পাশের রিকশা আরোহী কলেজছাত্রী সুমাইয়া আফরিন প্রীতি। পুরো কিলিং মিশন শেষ করে হত্যাকারীর পালিয়ে যেতে সময় লেগেছে মাত্র ৩০ সেকেন্ড।
টিপুর গতিপথ জেনে তাকে উল্টো পথে অনুসরণ করে আসা ও এত অল্প সময়ে কয়েকটি গুলি ছোড়ার কায়দা দেখে গোয়েন্দারা মনে করছেন, এটি পরিকল্পিত ও পেশাদার খুনির কাজ। ঘটনাস্থলের একটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এমনটা মনে করছেন তারা।
টিপু হত্যাকাণ্ডের সিসিটিভি ফুটেজটি ঘটনাস্থলের পাশের একটি বহুতল ভবনের। ভবনটির নিচতলায় একটি জুতার শোরুম ও বেসরকারি সাউথইস্ট ব্যাংক রয়েছে। এই ফুটেজে টিপু হত্যা মিশনের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
ফুটেজে দেখা যায়, শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদের একটু সামনে খিলগাঁও রেলগেট অভিমুখে বৃহস্পতিবার রাত ঠিক ১০টা ২৪ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে টিপুর ব্যক্তিগত সাদা রঙের নোয়াহ মাইক্রোবাসটি জ্যামে আটকা পড়ে। এর ঠিক ১০ সেকেন্ড আগে বিপরীত দিকের রাস্তা ধরে উল্টো পথে একটি মোটরসাইকেল আসতে দেখা যায়।
মোটরসাইকেলটি শাহজাহানপুর রেলওয়ে হাফিজিয়া সুন্নীয়া আলিম মাদ্রাসা ও এতিমখানার সামনে এসে ঘুরিয়ে আবার রাজারবাগ অভিমুখে দাঁড় করান চালক। এরই মধ্যে মোটরসাইকেলের পেছনে থাকা অস্ত্রধারী ও মাথায় হেলমেট পরা হত্যাকারী সড়ক বিভাজক পার হয়ে রাস্তার মাঝখানে অবস্থান নেন। এ সময় রাস্তায় খুব ধীরগতিতে অন্যান্য গাড়ি চলছিল।
ফুটেজে দেখা যায়, ১০টা ২৪ মিনিট ৫০ সেকেন্ডে টিপুর গাড়ির বাম দিক দিয়ে একেবারে কাছে গিয়ে প্রথম গুলি ছোড়া হয়। আচমকা আক্রমণ দেখে টিপুর গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন চালক মুন্না, কিন্তু সামনেই রিকশার জট থাকায় গাড়িটি বেশি দূর এগোতে পারেনি, তবে গাড়ি থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়ায় হামলাকারী দৌড়ে সামনে এসে খুব কাছ থেকে সামনের আসনে বসে থাকা টিপুকে লক্ষ্য করে পরপর কয়েকটি গুলি ছোড়ে। ওই সময় গাড়ির জানালার কাচ ভেদ করে গুলিবিদ্ধ হন টিপু। ১০ সেকেন্ড সময় ধরে টিপুকে গুলি করে আশপাশে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে টিপুর গাড়ির সামনে দিয়েই আবার সড়ক বিভাজক পার হয়ে রাস্তার উল্টো পাশে মাদ্রাসার সামনে দাঁড়ানো মোটরসাইকেলের দিকে চলে যান হত্যাকারী।
এরই মধ্যে টিপুর গাড়িঘেঁষা রিকশা থেকে কলেজছাত্রী প্রীতি রাস্তায় ঢলে পড়েন। ওই সময় টিপুর গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দুজন ব্যক্তিকে নেমে ছোটাছুটি করতে দেখা যায় এবং হামলাকারীকে ধাওয়া করতে দেখা যায়।
নিহত প্রীতি রাজধানীর বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী। তার বাসা মালিবাগে। ওই দিন বাসায় অতিথি থাকায় বান্ধবীর বাড়িতে রাত্রিযাপন করতে রিকশায় করে বান্ধবীর সঙ্গে তিলপাপাড়ায় যাচ্ছিলেন।
টিপু হত্যাকাণ্ডের সময় রাস্তার বিপরীত দিকে মাদ্রাসার সামনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চা পান করছিলেন স্থানীয় এক যুবক। তিনি পেশায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সোর্স। গুলির শব্দ পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বুঝতে না পেরে রাস্তার ওপারে টিপুর গাড়ির দিকে ছুটে যান তিনি, কিন্তু এরই মধ্যে কিলিং মিশন শেষ করে সড়ক বিভাজক পার হয়ে যান হত্যাকারী। ওই যুবক হত্যাকারীর পেছনে ধাওয়া করেন ধরার জন্য। এর মধ্যেই হত্যাকারী তার সহযোগীর মোটরসাইকেলের পেছনে চড়ে বসেন। এমন মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স পেছন থেকে মোটরসাইকেলে লাথি মারেন, কিন্তু ততক্ষণে মোটরসাইকেল চলতে শুরু করায় আর ধরা যায়নি।
হত্যাকারী ও তার সহযোগী শাহজাহানপুর থেকে রাজারবাগ অভিমুখে পালিয়ে যান, তবে তারা পালিয়ে গেলেও মোটরসাইকেলটির রং ও নম্বর প্লেটের নম্বর মনে রাখতে পারার দাবি করেন সোর্স, তবে নম্বর প্লেটে থাকা মোটরসাইকেলের অশ্বশক্তি নির্ধারণী বাংলা অক্ষরটি বুঝতে পারেননি তিনি।
সোর্সের ভাষ্য, মোটরসাইকেলটি ছিল মেরুন রঙের। এটি কোন ব্র্যান্ডের সেটি বলতে না পারলেও তিনি নিশ্চিত করেন, তাতে ডিজিটাল নম্বর প্লেট যুক্ত ছিল।
আর এর নম্বর ঢাকা মেট্রো-১১-১১৯৪ (এখানে একটি বাংলা অক্ষর হবে যেটি তিনি ঠিক বুঝতে পারেনি- যেমন ‘ল’ ‘হ’)। একই তথ্য তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও দিয়েছেন। মোটরসাইকেলের এই নম্বর ধরে খোঁজ নিচ্ছে একাধিক বাহিনীর সদস্যরা।
ওই যুবক বলেন, “আমি প্রথমে আওয়াজ হুইন্যা ভাবছি অ্যাকসিডেন্ট হইছে। এল্লাইগ্যা তাড়াতাড়ি রাস্তা পার হইয়া গাড়ির কাছে গেলাম। এর মধ্যেই একটা কালা জামা পরা হেলমেট পরা পোলায় দেখলাম ভাগতাছে। সবাই চিল্লাইতাছে ‘ধর ধর’ কইয়্যা। আমি তখন মনে করলাম ছিনতাইকারী। বাহিনীর সোর্স হইয়া কাজ করি কত বছর ধইরা, কত চোর ছিনতাইকারী ধরলাম জীবনে।
“ওই পোলায় দেখি গিয়া হোন্ডাতে উঠল, স্টার্ট দেওয়া আছিল। আর লগে লগেই টান দিল। আমি ধরার শেষ চেষ্টা করতে উইড়া গিয়া হোন্ডাতে একটা লাত্থি মারলাম, কিন্তু ঠিকমতো লাগল না। হোন্ডা টান দিয়া পলায় গেল দুইডা। পরে যখন গিয়া দেখলাম দুইডা মার্ডার তখন ডরাইছি, না বুইজ্যা গেছিলাম ধাওয়া দিতে, আমারে যদি গুলি কইরা দিত?”
এদিকে সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে প্রাথমিক কিছু বিষয় নিশ্চিত হয়ে তদন্তকাজ শুরু করেছে পুলিশসহ অন্য গোয়েন্দারা। তাদের মতে, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড আর হত্যাকারী পেশাদার ও দক্ষ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘উল্টো পথে মোটরসাইকেল আসার টাইমিংটা খেয়াল করলে বোঝা যায়, তারা ওই গাড়িটা অনেকক্ষণ ফলো করে এ পর্যন্ত এসেছে। ভিকটিমকে ফলো করে এসে সামনে জ্যাম দেখে এটাকেই কিলিং স্পট হিসেবে ফিক্স করে ফ্লাইওভারের ইউটার্ন দিয়ে উল্টো পথে এগিয়ে গিয়ে পজিশন নিয়েছে। পজিশন নেয়ার ৫ সেকেন্ডের মধ্যেই ভিকটিমের গাড়ি সেখানে পৌঁছে যায়।’
‘এটাতে বোঝা যায় তারা হয়তো ভিকটিমের গতিপথ আগে থেকেই রেকি করেছে। আর শুটিং (গুলি করার) দক্ষতা আছে। তাও পরিষ্কার।’
‘কারণ এত কম সময়ে টার্গেট শট করে আবার স্মুথ এক্সিট করেছে। নিঃসন্দেহে এরা পেশাদার শুটার।’সূত্র-
পূর্ব পশ্চিম