শিক্ষা যদি হয়- “ছাগলের এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যাওয়া” কিংবা “সারারাত রামায়ণ পড়ার পর সকালে জানতে চায় সীতা কার বাপ” অথবা “দাদায় কইছে ভানতে ধান, ভানতে আচে ওদা ধান” বা “হিলাইচোততি, কয় হিলাইছি, লড়েনি, কয় লড়ে”। তাহলে অবধারিতভাবেই একটি প্রশ্ন জাগে- এমন শিক্ষা থেকে আপনি কতটা শিক্ষিত হচ্ছেন? যারা আপনাকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার দায়িত্বে নিয়োজিত বা নিবেদিত তারা তাদের জ্ঞান,তাদের অভিজ্ঞতা বা তাদের শিক্ষা দিয়ে আপনাকে কতটুকু শিক্ষিত বা সমৃদ্ধ করতে পারবেন। আপনার উদ্দেশ্য বা তাদের উদ্দেশ্য কতটুকুই বা পূরণ হবে। আমরা যদি একটা বিষয় সূক্ষ্মভাবে কিংবা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখি যে, আমাদের জন্মলগ্ন থেকে আমরা ধীরে ধীরে কীভাবে শিক্ষিত হতে থাকি বা শিক্ষার এক একটি ধাপ আমরা কীভাবে অতিক্রম করতে থাকি? তাহলে আমরা এর সহজ উত্তর যেটি পাবো তাহলো- একদম ছোটবেলায় পরিবারে আমাদের শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। বাবা-মা আমাদের প্রথম শিক্ষক-শিক্ষিকা। তারপর আমরা স্কল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে আমরা শিক্ষা জীবনের একটা উচ্চ ধাপে পৌঁছে যাই। তখন জনগণ এবং রাষ্ট্র আমাদেরকে শিক্ষিত নাগরিক বা শিক্ষিত শ্রেণি হিসেবে গণ্য করে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, আমাদের কলেজ, মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হওয়া শিক্ষার্থীদের কত পার্সেন্ট সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত বা সুশিক্ষিত হচ্ছে? যদি তারা সকলে প্রত্যাশিতভাবে শিক্ষিত বা সুশিক্ষিত নাও হয়ে থাকে তারা কিন্তু সার্টিফিকেট পেয়ে যাচ্ছে! তাহলে তাদেরকে বলা যায় সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত! তবে কি আমরা শিক্ষিত বা সুশিক্ষিত বলতে সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত বুঝাচ্ছি নাকি অন্য কিছু? সেটা আবার অন্য বিতর্কের বিষয়। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম ও একটা নির্ধারিত কাঠামোর মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জন করে থাকে, সার্টিফিকেট অর্জন করে থাকে। এক্ষেত্রে রেজাল্ট কারও ভালো হচ্ছে এবং কারও তুলনামূলক খারাপ হচ্ছে! যাদের রেজাল্ট ভালো হচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান বা ভূমিকা কতটুকু? আবার যাদের রেজাল্ট খারাপ হচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় কতটুকু? একইভাবে ভালো বা খারাপের ক্ষেত্রে শিক্ষক, বাসার টিউটর, কোচিং সেন্টার এর অবদান বা দায় কতটুকু? অনেক শিক্ষার্থী নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে, ভালো শিক্ষক, ভালো কোচিং সেন্টার কিংবা ভালো টিউটর অথবা একাধিক টিউটরের কাছে পড়েও অনেক সময় ভালো রেজাল্ট অর্জন করতে পারে না। অনেক বিত্তবান লোকের ছেলেকে শিক্ষার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করে, অনেক আবদার পূরণ করেও শিক্ষিত কিংবা সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিতও বানানো যায় না! অন্যদিকে অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা সামান্য গাইডলাইন পেলে, কিছুটা সহায়তা পেলে মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত বা গরীব পরিবারের হলেও প্রতিষ্ঠান নামকরা না হলেও অনেক ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করতে পারছে। অনেকে অভাব-অনটন বা অত্যন্ত কষ্টে থেকে লেখাপড়া করেও স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে গিয়ে সরকারি টাকায় ডিগ্রি অর্জন করছে এবং উচ্চ শিক্ষিত বা সুশিক্ষিতও হচ্ছে।
এই লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে- মূলত একটা বিষয়ে আমাদের সাধারণ ভাবনা থেকে বেরিয়ে একটু ভিন্নভাবে ভাবার সুযোগ করে দেওয়া। তাছাড়া আমাদের শিক্ষার্থীদের নিকট কিছু বিষয় পরিষ্কার করা। আচ্ছা বলুন তো, আমাদের কোনো শিক্ষার্থীকে সারাদিন ধরে কোনো ভালো শিক্ষক যদি পড়াতে থাকেন, কোনো বিশাল লাইব্রেরি, বইয়ের জগতে কিংবা জ্ঞানের রাজ্যে কোনো শিক্ষার্থীকে যদি ছেড়ে দেওয়া হয় তবে কি সে শিক্ষিত বা সুশিক্ষিত হয়ে যাবে অথবা তার কি ব্যাপক জ্ঞান অর্জন হয়ে যাবে? কিংবা সে কোনো পরীক্ষা দিলেই ভালো ফলাফল অর্জন করে ফেলবে? আমি জানি- আপনার উত্তর শর্তাধীনে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ যে কোনোটাই হতে পারে। তবে জ্ঞান-বিজ্ঞান আপনার কাছে যতই আসুক অথবা যতই থাকুক আপনি যদি সঠিকভাবে গ্রহণ কিংবা অর্জন করতে না পারেন এবং সময়মতো কাজে লাগাতে না পারেন, তাহলে ফলাফল কী হতে পারে- এর উত্তর নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে। এক্ষেত্রে আমি একটি বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করি। একদিন আমি একটি বিদ্যালয় আকস্মিক পরিদর্শনকালে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য পঠিত একটি বিষয়ে তাৎক্ষণিক ছোট্ট একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করলাম। বোর্ডে আমি কয়েকটি প্রশ্ন লিখে দিয়ে বললাম- দ্রুত উত্তর লিখে আমার কাছে জমা দিলে এবং উত্তর সঠিক হলেই তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে। আমি দেখলাম, দুইজন শিক্ষার্থী দ্রুত উত্তর লিখে প্রায় একই সময়ে আমার হাতে জমা দিয়েছে। কিন্তু তারা দুইজনেই সঠিক উত্তর লিখেছে। তাদের উত্তর সঠিক হয়েছে- একথাটি আমি আর কাউকে না বলে আরও প্রায় তিন মিনিট সময় অপেক্ষা করেছি। কিন্তু তখন পর্যন্ত নতুন করে আর কারও উত্তরপত্র না পেয়ে আমি বলেছি, ঠিক আছে তোমরা আর কেউ খাতা জমা দিতে হবে না। আমার হাতে যে দুইজনের খাতা এসেছে দুইজনেই সঠিক উত্তর করেছে। তারা দুইজনই বিজয়ী। তাদেরকে পুরস্কারও প্রদান করেছি। এই ঘটনায় অনেক বড় শিক্ষণীয় একটা বিষয় রয়েছে। সেটা হলো- দুইজন শিক্ষার্থী এতো দ্রুত উত্তর করতে পারলো, আর অন্যরা অনেক সময় বেশি পেয়েও পারলো না কেন? এর উত্তর হচ্ছে- সকলেই হয়তো ঐ বিষয়টি পড়েছে। কিন্তু কেউ ভালোভাবে পড়েছে, আবার কেউ খারাপভাবে পড়েছে। যাদের পড়া যথাযথ হয়নি তারা হয়তো স্মরণ করতে পারছিল না বা দ্বিধান্বিত ছিল। যথাসময়ে উত্তর লিখেও জমা দিতে পারেনি। যার ফলে তারা পিছিয়ে গেল। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। যারা পড়াশুনা করে, যারা পরিশ্রমী তারা সফল হয়। তারাই ভালো ফলাফল অর্জন করে।
আমরা আমাদের বিভিন্ন বক্তব্যে কিংবা কথায় কথায় অকপটে বলতে থাকি- আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উন্নত শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সুশিক্ষিত করতে হবে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত ও মানসম্মত করতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে ইত্যাদি বহু কথা আমরা সচেতনভাবে কিংবা অবচেতনভাবে বলে থাকি, আর একাজে শিক্ষকগণকেই বেশি দায়িত্ব দিয়ে থাকি। এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে- প্রকৃতপক্ষে আপনাকে বা একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত বা সুশিক্ষিত করবে কে? এর উত্তরে আসা যাক। আমার দৃষ্টিতে এই প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর হওয়া উচিত আপনি নিজে। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থীর কথা যদি বলি, তাহলে সে নিজেই তাকে শিক্ষিত, সুশিক্ষিত বা প্রকৃত শিক্ষিত করে গড়ে তোলা, নৈতিকভাবে শিক্ষিত অথবা মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন বা সফল ব্যক্তি হিসেবে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভুমিকা পালন করে। উপরের বর্ণনা দ্বারা যে বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করেছি তা থেকে এটি স্পষ্ট যে, একজন শিক্ষার্থীর জন্য পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ভালো শিক্ষক, কোচিং সেন্টার এরা সহায়ক বা ফ্যাসিলিটেটর মাত্র। তাদের কোনো দায়িত্ব, ভূমিকা বা অবদান নেই একথা আমি বলছি না। তবে তাদের চেয়ে বড় অবদান রাখতে পারে একজন শিক্ষার্থীর নিজের দায়িত্বশীল কর্মকাণ্ড। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে তার মূল কাজ হচ্ছে- পড়াশুনা করা, মনোযোগ সহকারে পড়াশুনা করা, নতুন নতুন জ্ঞান অন্বেষণ ও অর্জন করা, নিজেকে সমৃদ্ধ করা। উচ্চ শিক্ষিত বা সুশিক্ষিত হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত বা যোগ্য করে তোলা। এক্ষেত্রে তার নিজের প্রাণপণ চেষ্টা থাকতে হবে। আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। স্বপ্ন থাকতে হবে, স্বপ্নপূরণের তাড়না থাকতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান বা অন্যের চেষ্টাতে তার বেশি লাভ হবে না বললেই চলে। শিক্ষক, অভিভাবক বা অন্য কেউ শুধুমাত্র পরামর্শ বা দিক-নির্দেশনা দিতে পারবেন। কোনো পড়া বুঝিয়ে দিতে শিক্ষক সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে পারবেন, কিন্তু এক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী হচ্ছেন জ্ঞানগ্রহীতা বা জ্ঞান অর্জনকারী। তাহলে জ্ঞানগ্রহীতা বা জ্ঞান অর্জনকারী হিসেবে একজন শিক্ষার্থী যদি সঠিকভাবে জ্ঞান গ্রহণ বা অর্জন করতে না পারেন তাহলে এক্ষেত্রে শিক্ষক কী করতে পারবেন? সুতরাং বলা যায়, একজন শিক্ষার্থী নিজেই তাকে শিক্ষিত বা সুশিক্ষিত করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভুমিকা পালন করে।
লেখক:
শরীফ উল্যাহ
উপজেলা নির্বাহী অফিসার
লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।