তিনি পরিষ্কার উপলব্ধি করেছিলেন যে মুসলিম লীগের সাথে থেকে বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই মাউন্টব্যাটেনের ৩ জুন পরিকল্পনা ঘোষণার সাথে সাথে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের সিরাজোদ্দৌলা হোস্টেলে ছাত্র ও যুব নেতাদের নিয়ে এক রুদ্বদ্বার বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন এবং পূর্ব বাংলায় লীগ বিরোধী ছাত্র, যুব ও রাজনৈতিক কর্মীদের সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
আর এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভারত বিভাগের পরপরই তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ঢাকায় মুসলিম লীগ বিরোধী ছাত্র, যুব ও রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। ফলশ্রুতিতেই প্রদেশব্যাপী প্রস্তুতির পর শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমেদ, শামসুল হক, তাজউদ্দীন আহমেদ, শামসুদ্দীন আহমেদ, তসাদ্দক আহম্মেদ প্রমুখের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গঠিত হয় পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও এর সভাপতি মনোনীত হন তসাদ্দক আহমেদ। এই সংগঠনটি ছিল সারা পাকিস্তানে একমাত্র অসাম্প্রদায়িক সংগঠন।
যুবলীগ নবগঠিত পাকিস্তানের গণতন্ত্র, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও ভাষা বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। উক্ত প্রস্তাবে বলা হয় : বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্ত ই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক। এছাড়া যুবলীগ তার প্রচারিত ইস্তেহারে আরও দাবি করে যে, রাষ্ট্রের অধীনস্ত বিভিন্ন এলাকার পৃথক পৃথক সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশকে সরকার স্বীকার করিয়া নিবেন, জীবন এবং সংস্কৃতিকে গড়িয়া তুলিতে এইসব এলাকার সকল ব্যাপারে স্বায়ত্তশাসন মানিয়া লইতে হইবে।
যদিও সরকারী দমন-নির্যাতন, সরকারী-বেসরকারী প্রেস মিডিয়াগুলোর অসহযোগিতার কারণে ১৯৪৮ সালেই গণতান্ত্রিক যুবলীগের বিলুপ্তি ঘটে তা সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনে এই সংগঠনটির ভূমিকা কম নয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এটিই ছিল প্রকৃত অর্থে প্রথম সরকার বিরোধী সংগঠন; সরকারের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রথম প্রতিবাদ। উল্লেখ্য যে, এসময় (১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রের সমন্বয়ে তমদ্দুন মজলিশ নামে একটি ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম। এই সংগঠনটির উদ্দেশ্য ছিল ‘কুসংস্কার, গতানুগতিকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা দূর করে সুস্থ ও সুন্দর তমদ্দুন গড়ে তোলা, খ. যুক্তিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ধর্মভিত্তিক সাম্যবাদের দিকে মানব সমাজকে এগিয়ে নেয়া, গ. মানবীয় মূল্যবোধের ওপর সাহিত্য ও শিল্পের মারফত নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করা এবং ঘ. নিখুঁত চরিত্র গঠন করার লক্ষ্যে গণজীবনের উন্নয়নে সহায়তা করা। সংগঠনটি ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এতে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করার দাবি জানানো হয়। এতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, আদালত ও অফিসের ভাষা হবে বাংলা। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা থাকবে দুটি উর্দু ও বাংলা। পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগের প্রথম ভাষা হবে বাংলা, দ্বিতীয় উর্দু এবং তৃতীয় ভাষা হবে ইংরেজী।
উক্ত পত্রিকায় আবুল মনসুর আহমদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল কাসেম প্রমুখ বুদ্ধিজীবী বাংলা ভাষার সপক্ষে জোরালো যুক্তি সহকারে বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখে বাংলার শিক্ষিত সমাজকে সচেতন করে তোলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম দিকে তমদ্দুন মজলিশের ভূমিকা বেশ সক্রিয় হলেও ভাষার দাবিতে আন্দোলনের সাথে সাথে বাঙালি সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রকট হতে থাকলে এই সংগঠনটি নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর মযহারুল ইসলাম লিখেছেন, “পরবর্তীকালে এই তমদ্দুন মজলিশ যদিও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে দূরে সরে গিয়েছিল তবু ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে এর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। মুসলিম সংস্কৃতি বলতে যে আরবীয় সংস্কৃতির চিন্তা এঁদের মনে ছিল বাংলা জাতীয়তাবাদ চেতন প্রকট হবার সাথে সাথে তার সাথে তাদের গরমিল দেখা দিল স্বাভাবিকভাবেই বাংলা জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে এরা আর সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারলেন না।