চল্লিশের দশকে জন্ম একটি ছেলে শিশুর। শিশুটির জন্মের একবছর পরেই সে পিতৃহীন হয়ে পড়ে। দাদার হাতেই তার বেড়ে ওঠা। বাবা না থাকায় পরিবারে তেমন গুরুত্ব ছিলনা শিশুটির। যখন তার স্কুলে যাবার বয়স তখন একদিন স্কুলে যাবার পর তার চাচা তাকে বলেছিল লেখাপড়া করে কি হবে? যদি মানুষকে গোদারা (নৌকা) পার করে দিস তাহলে প্রতিদিন টাকা পাবি। তারপর তার আর বিদ্যালয়ের চৌকাঠে পা রাখার সুযোগ হয়নি। এভাবে জীবন যুদ্ধ করে যখন সে পরিণত বয়সে এলো তখন তার দাদা তাকে বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দিল। তার যে সহধর্মিণী তার জীবন কাহিনী ছিল আরও করুণ। বিকলাঙ্গ মায়ের ঘরে জন্ম হওয়া বড় মেয়ে। এগারো ভাইবোনের সংসারের বেশির ভাগ কাজই তার করতে হতো। লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছা থাকার পরও একদিন বিদ্যালয়ে যাবার পর আর ওই রাস্তায় হাঁটতে পারেনি। কারণ তার বাবার মন মানসিকতায় ছিল গোঁড়ামি। স্কুলে যাবার অপরাধে মেয়েকে মারধর করে বলেছিল ‘ মেয়েদের আবার কিসের লেখাপড়া?’ তখন ঐ বাবা বুঝতে পারেনি যে সে তার মেধাবী মেয়েকে ধ্বংস করে দিল।
এ দুজন মানুষের সম্মিলনে পৃথিবীতে এসেছে ৫টি প্রাণ। ২টি প্রাণকে তারা ধরে রাখতে পারেনি। তবে যে তিনজন আছে তাদের ক্ষেত্রে মানুষ দুটির ছিল আপ্রাণ চেষ্টা। নিজেরা লেখাপড়া জানতো না বলে ছোট বেলা থেকে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। নির্দিষ্ট বয়সে বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে আবার প্রাইভেট টিউশনের ব্যবস্থা করেছে। ছেলে মেয়েদের জন্য নিয়ম ছিল মাগরিবের আযানের আগে খেলাধুলা শেষ করে ঘরে ফিরে আসতে হবে। সন্ধার পরে যখন সবাই পড়তে বসতো ওপাশ থেকে বাবা বলতো তোরা আওয়াজ করে পড়। পড়ায় যেন শব্দ হয়। নিরবে পড়া যাবে না। গণিত করতে হতো দিনের বেলা। হাতের লেখার কাজটাও দিনে শেষ করতে হতো। একদিন ছোট মেয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো আপনি আমাদের জোরে পড়তে বলেন কেন? বাবার উত্তর ছিল গল্পের বই পড়িস না পড়ার বই পড়িস কিভাবে বুঝবো? তাই শব্দ করে পড়তে বলি। শব্দ করে পড়ার কয়েকটা ভালো দিক ছিল। আওয়াজ করে পড়ার কারণে ফাঁকি দেয়া যেতো না। ফলে মনোযোগ চলে আসতো। আর বাবা নিরক্ষর হলেই তার জ্ঞানের পরিধি ছিল ব্যাপক। যেকোনো কিছু দেখে তিনি পড়তে পারতেন। নিয়মিত বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার খবর শুনতেন। রেডিও, টেলিভিশনের খবর শুনতেন। তাই পড়তে বসে ছেলে মেয়ে কোন ভুল পড়লে তা সংশোধন করে দিতেন। ছোট বেলা থেকে শব্দ করে পড়তে পড়তে সবারই সাবলীল ভাবে পড়ার যোগ্যতা অর্জিত হয়েছিল।
ছেলেমেয়েদের লেখা পড়া ছাড়াও খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণে বাবার আগ্রহটা ছিল তীব্র। যেকোনো ভালো কাজকেই তিনি স্বানন্দে গ্রহণ করতেন। প্রতিটা ভালো কাজের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতেন।
এতক্ষণ যে বাবার বর্ণনা করা হলো সে আমার জন্মদাতা পিতা মোঃ মতি মিয়া। ছোট বেলা থেকে আমার বাবার ভিতরে যে সুপ্ত গুণ গুলো দেখেছি তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। আমার বাবা ছিলেন ঠিকাদার। বাবাকে বলতাম আব্বা কত মানুষের বাড়িতে দালান তৈরি করে দেন আর আমরা টিনের ঘরে থাকি। বাবা উত্তরে বলতেন আগে তোরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে নে। দেখ আমাদের এলাকায় অনেক অর্থবিত্তবান দালান কোঠার মালিক আছে কিন্তু
সন্তান মানুষ হয়নি তাই তারা সম্মান পায় না। আমাদের বাসায় সাদাকালো টিভি ছিল। আব্বাকে যদি বলতাম একটা রঙিন টিভি কিনেন আব্বা বলতো তাহলে তোদের চোখ টিভিতেই আটকে যাবে পরালেখায় মন বসবে না। আমার অনার্স শেষ হওয়ার পর বাসায় রঙিন টিভি এসেছে। ল্যান্ড ফোন এসেছে। আর মাস্টার্স শেষ করে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর বাসায় ডিশ সংযোগ হয়েছে। এটা দেখে বাবাকে বললাম এখনতো আপনি পরিপূর্ণ। সবই হয়েছে আপনার। আব্বা আমাকে বললো এখনতো তোদের লেখাপড়া নেই আবার তোরা আমার কাছ থেকে দূরে চলে গিয়েছিস। তাই আমার সময় কাটানোর জন্য এ আয়োজন। আমাদের বাড়িতে এখন দালানও তৈরি হয়েছে।
আমার বাবার এ উন্নত মানসিকতার কারণেই আজ আমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। আমার বাবা একজন প্রধান শিক্ষকের বাবা হিসেবে সম্মান পায়। আমার প্রতিটা কাজেই বাবা আমাকে পরামর্শ দেয়। বাবার দিক নির্দেশনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। কোন কাজে ভুল হলে বাবা এখনো ধমক দেয়, বকা দেয়। বাবা কিছু লিখতে দিলে যদি ওভাররাইট হতো তাহলে রেগে যেয়ে বলতো মরা গাছে পানি ঢালছি। তাই আব্বা কিছু লিখতে দেয়া মানে বিশেষ সতর্কতা। আর এ কারণেই হয়তো এ অভ্যাসটা তৈরি হয়নি। আসলে বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা বলে বা লিখে শেষ করার মতো নয়। আজও বাবার প্লেট থেকে হাড়টা তুলে আমাকে দেয় আমি পছন্দ করি বলে। আমার বাবা আমার অহংকার। আমি স্যালুট জানাই তোমাকে বাবা।
রোকশানা আক্তার, প্রধানশিক্ষক, দক্ষিণ মেদিনী মণ্ডল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,লৌহজং,মুন্সিগঞ্জ।