“আমি বলবো কি? আর শুনবে কে?
বুঝবে কিরে ধুন্দা,
এই দুনিয়া মায়ার জালে বান্ধা।”
(মলয় সংগীত)
মনমোহন দত্ত ছিলেন মলয়া সংগীতের জনক। মরমী সাধক, কবি, বাউল, সমাজ সংস্কারক ও অসংখ্য অসাধারণ গানের গীতীকার,সুরকার
আধ্যাতিক কবি মনমোহন দত্তের গানের সাথে তাল মিলিয়ে আমার ও বলতে ইচ্ছা করে-
আমি লিখবো কি আর পড়বে কে?
সবাই করে ধান্ধা,
মনমোহন দত্ত ঠিকই বলছেন,
এই দুনিয়া মায়ার জালে বান্ধা।
– করো টাকার মায়া,কারো ক্ষমতার মায়া, কারো জীবনের মায়া, কারো পুত পরিজনের মায়া। আবার কারো কারো প্রভাব-প্রতিপত্তি ধন- সম্পদের মায়া।
এই মায়ার জগত থেকে বেরিয়ে আশা অতি দূরহ কাজ। যতদিন পর্যন্ত আপনি মায়ার জাল ছিন্ন করে বেড়িয়ে আসতে না পারবেন, তত দিন পর্যন্ত আপনি নিজেকে শুদ্ধ ভাবতে পারবেন না।
না, আধ্যাতিক সুদ্ধতা, না সামাজিক শুদ্ধতা,
রাজনৈতিক শুদ্ধতা, পারিবারিক শুদ্ধতা।
নিজেকে শুদ্ধ ভাবতে যেয়ে অধিকাংশ সময় আমারা নিজের সাথে নিজেই প্রতারনা করি।
শুধু নিজের সাথে নয়, সমাজের মানুষের সাথেও।
সমাজের সাধারন মানুষ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ভাবে আপনার/ আমার দ্বারা প্রতারিত হয়। শুধুকি তাই? বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ বিভিন্ন ভাবে তাদের জিম্মি করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে।
একবার নিজে ভিকটিম হয়ে দেখেন, তাহলে বুঝতে পারবেন-
“কত ধানে কত চাল।”
একটা বিপদে পড়লে কেউ আপনার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবে বলে মনে হয় না। বরং সবাই যার যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
আপনার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটানা নিয়ে- সাংবাদিক রিপোর্ট লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, কবি কবিতা লিখবে, ইউটিউবার কনটেন্ট তৈরি করবে, পথচারীরা উহ আহ করবে? পুলিশ রহস্য উদঘাটনের জন্য মরিয়া হয়ে যাবে।
কিন্তু কেউ আপনার সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করবে না। ঘটনা যাই হউক, ঘটনার রহস্য উদঘাটনের জন্য পুলিশ আপনাকে থানায় নিয়ে যাবে। সাংবাদিক আপনার ইন্টারভিউ নিবে। ইউটিউবারা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার মৃত্যুর সংবাদ দিয়ে ভিউ বাড়াবে।
আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক ইস্যু খোঁজার চেষ্টা করবে। তারা ঘটনার বিষয়ে আপনাকে একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাবে। আপনি আরেকটা ঝামেলায় পড়বেন।
সাধারন মানুষের মধ্যে কেউ কেউ প্রচলিত সমাজের এই অসমর্থিত রীতিনীতি বুঝতে পারলেও অনেকে বুঝতে পারে না।
যারা তুলনা মুলক একটু চালাক চতুর শুধু তারাই এই প্রতারনার বিষয়টি বুঝতে পারে। তাইতো মাঝে মাঝে তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠে। যদিও সেই প্রতিবাদ কোন কাজে লাগে না।
লাগবেই বা কেমনে? এটাও সত্য, সমাজের এত সব অনিয়মের বিরুদ্ধে একজন নিরহ মানুষ একা একা প্রতিবাদ করে কোন বিপ্লব ঘটাতে পারে না।
সমাজে কিছু সহজ-সরল, সাদা-সিদা আবেগি মানুষ আছে, যারা সব কিছু সহজে বিশ্বাস করে, তারাই বেশী প্রত্যারিত হয়।
প্রতারিত হওয়ার পরেও তারা কাউকে কিছু বলতে সাহস পায় না। কিছু না হওয়ার ভান করে চুপচাপ সহ্য করে। কারন তারা মনমোহন দত্তের সাথে একমত। তারাও মনে করে-
“আমি বলবো কি? আর শুনবে কে?
বুঝবে কিরে ধুন্ধা।
নির্যাতিতদের কাছে সমাজের সকল মানুষ ধুন্ধা অথাৎ বয়রা। একটু খোলামেলা বলার চেষ্টা করি-
আমাদের সমাজে সাধারণ মানুষের অবস্থাটা এমন হয়েছে যে-
সত্য কথা বললে- মায়ে মাইর খায়, আর মিথ্যে কথা বললে- বাপে হারাম খায়।
তাইতো কথা বলার অধিকার থাকলেও কেউ বলতে চায় না।
কি বলতে কি বলবে, পরে আবার কোন ঝামলায় পড়ে যাবে। একবার যদি ভেজাল বেজে যায় তবে তা থেকে রেহাই পাওয়া বড় দুস্কার।
ভেজাল কথাটা মাথায় আসার পর ছোট সময়ের একটা ঘটনা মনে পড়লো। আশির দশকে চরমুগুরিয়ায় একজন পাগল ছিল, সে সব সময় ছালার চট পড়ে হাওলাদর জুট মিলের আশেপাশে বসে থাকতো। সবাই তাকে ভেজাল পাগলা বলে চিনতো। ছালার চট পড়ে বসে থাকতো বলে কেউ কেউ তাকে ছালা পাগলাও বলতো।
সে সব সময় চুপচাপ বসে থাকতো। কাউকে কোন ডিসটার্ব করতো না। কিন্ত একটা বিষয় সবাইকে ভাবিয়ে তুলতো হঠাৎ হঠাৎ সে বিরক্তির স্বরে জোরে জোরে গালি দিয়ে বলতো-
” শালার বেটা শালারা, ইচা মাছ খাইয়া ভেজাল বাজাইছে”।
বয়সে ছোট, তাই তাকে দেখে ভীষন ভয় পেতাম। তার কথাও ঠিক মতো বুঝতাম না।
তার এই ডায়লক শোনার পর থেকে সব সময় আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেত,
– কার ইচা মাছ, কে খাইল? কে ভাজাল বাজাইলো? কিসের ভেজাল?
আবার মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করতাম আমাকে বলছে না তো!
না, আমাকে বলবে কেন? আমি তো দুই চারদিনের মধ্যে ইচা মাছ খাই নাই। নিজের প্রশ্নের নিজেই উত্তর দিতাম।
তাহলে পাগলা কাকে বলছে?
ইচা মাছের খবর তাকে কে দিল? কেনই বা সে বার বার একই কথা বলছে?
মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন জাগ্রত হতো। অদধি সেই প্রশ্নের কোন উত্তর পাইনি।
প্রশ্নের উত্তর না পাইলেও মনে প্রানে বিশ্বাস করছি।
– কেউ না কেউ ইচা মাছ খাইছে। সেই ইচা মাছ খাওয়ার পর নিশ্চায়ই কোন ঝামেলা হইছে, নইলে পাগল বার বার একই কথা বলবে কেন?
(পরবর্তীতে এই ভেজাল পাগলকে নিয়ে অনেক আধ্যাতিক গল্প শুনেছি)
কে খাইল ইচা মাছ? কি ভেজাল বাজাইল? এ কথা পাগলকে জিজ্ঞাস করার মত সাহস কারো ছিল না। সুতরাং ভেজাল পাগলার সেই ইচা মাছ খাওয়ার ভেজাল টা মাথার মধ্যে রইয়েই গেল।
সেই যে মাথার মধ্যে একটা ভেজাল ডুকল, তারপর থেকে শুধু ভেজাল আর ভেজাল। ভেজাল ছাড়া একটা দিনও পার করতে পারি না।
প্রাকৃতিক ভেজাল, রাজনৈতিক ভেজাল, অর্থনৈতিক ভেজাল, পারিবারিক ভেজাল, ভেজাল এর পর ভেজাল। ভেজাল যেন আর ছাড়ছেই না।
তাই মাঝে মাঝে মনে হয় কোন দিন যেন ভেজাল পাগলার মতো একটা ভেজাল মুখে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাই।
এত ভেজাল দেখতে আর ভাল লাগে না। শিক্ষায় ভেজাল, প্রসাশনে ভেজাল, খাদ্য দ্রব্যে ভেজাল, পরিবহনে ভেজাল, চিকিৎসায় ভেজাল। এক কথায় বলতে পারেন ভেজাল নেই কোথায়?
এখন তো বলতেই হয়, যার সর্বাঙ্গে ব্যাথা,
তার ঔষধ দিব কোথা?”
– তারপর আবার নিজেকে নিজে শান্তনা দেই, যে ইচা মাছ খাইছে, সে ভেজাল বাজাইছে। সেই ভেজাল ছাড়ানোর দায়িত্বও তার। আমি ছোট মানুষ আমি বাপু অতসব বুঝি না।
আমি কোন ভেজালের মধ্যে নেই। তার চেয়ে ভালো, আসুন ঘরে শুয়ে শুয়ে মলয় সংগীত শুনি-
“আমি বলবো কি? আর শুনবে কে?
বুঝবে কিরে ধুন্দা……
এই দুনিয়া মায়ার জালে বান্ধা।”
লেখকঃ জানে আলম মুনশীক- কবি ও ছড়াকার।