আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন লুটপাটের চিত্র আরও দৃশ্যমান হচ্ছে। এ কারণে ব্যাংক খাতের মূল সূচকগুলো ‘উদ্বেগজনক’ পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই প্রানি্তকেই ‘ব্যাংক খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে’। কারণ, খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংক খাতের সম্পদের মান নিম্নমুখী হয়েছে। ঋণ ও আমানতের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অতিরিক্ত তারল্য ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। মূলধন কমার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর আয়ও কমে যাচ্ছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে ব্যাংক খাতের এমন নেতিবাচক চিত্র পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর ব্যাংক খাত সংস্কারে একটি ট্রাস্কফোর্স গঠন করে। তাদের কাজ চলছে। বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছে। ব্যাংক খাতের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। ফলে আমানত বাড়ছে। ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় লুটপাটের ক্ষত সেভাবে প্রকাশ্যে আসেনি। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এখন ক্ষতগুলো প্রকাশিত হচ্ছে। এতে দৃশ্যমান হচ্ছে লুটপাটের প্রভাব।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রানি্তকেই (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যাংক খাত উলে্লখযোগ্যভাবে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। মূল সূচকগুলো উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে গেছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি শতকরা হারও বেড়েছে। প্রভিশনে হার কমায় নিট খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকের ঋণ এবং আমানতের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ গত জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ৩৪ দশমিক ৮১ শতাংশ বেড়েছে। আগে কখনো এত বেশি হারে বাড়েনি। খেলাপি ঋণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মানকে নিম্নমুখী করেছে। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানের করেছে। এটি আগামী এপ্রিল থেকেই কার্যকর হওয়ার কথা। এটি কার্যকর হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণের হার আরও বেড়ে যাবে। তখন সংকট আরও তীব্রতর হতে পারে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৪০ দশমিক ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় এ হার ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বেসরকারি ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোয় এ হার বেড়েছে। তবে তুলনামূলকভাবে কম।
ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ায় প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। এতে ব্যাংকগুলোয় সামগ্রিক মূলধন ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বেড়েছে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের মান। কমেছে সম্পদের গুণগত মান। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে মূলধন রাখার হার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের অনেক নিচে নেমে গেছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বা ব্যাসেল-৩ (সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেল শহরে সম্পাদিত ব্যাংকিং বিষয়ক চুক্তি) অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। গত জুনে মূলধন সংরক্ষণের হার ছিল ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ বাড়ায় এবং প্রভিশন কমায় মূলধন সংরক্ষণের হার ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে এসেছে। মূলধনের হারে এই পতন মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কারণে ঘটেছে। কারণ, এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যেমন বেশি বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে প্রভিশন
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, খেলাপি ঋণ বাড়ায় ব্যাংকগুলোর অকার্যকর সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে আয়যোগ্য সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে। এতে ব্যাংক খাতে আয়ের হার কমে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর প্রধান আয় হয় ঋণের বিপরীতে সুদ বা মুনাফা থেকে। করোনার পর বৈশ্বিক মন্দা ও লুটপাটের প্রভাবে ব্যাংক খাতে ঋণ আদায় যেমন কমেছে, তেমনই সুদ বাবদ আয়ও কমেছে। এ কারণে ঋণ বা সম্পদ থেকে ব্যাংকগুলোর আয় কমে গত ১৮ বছরে সর্বনিম্নে পৌঁছেছে। ২০০৮ সালে সম্পদ থেকে আয় হতো ১ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ছিল দশমিক ৫৯ শতাংশ। ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত তা কমে দশমিক ২৩ শতাংশে নেমেছে। মূলধন থেকে আয় ২০২৩-এর ডিসেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গত মার্চে তা নেমে এসেছে ৪ দশমিক ৩২ শতাংশে। আগামী দিনে আয়ের হার আরও কমে যেতে পারে। কারণ, বর্তমানে লুটপাটের ও লুকানো খেলাপি ঋণের তথ্য বেরিয়ে আসায় আয় আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এতে আরও বলা হয়, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ঋণ ও আমানত উভয়ের প্রবৃদ্ধি উলে্লখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। আমানতের সুদ বা মুনাফার হার বৃদ্ধির পরও ব্যাংকগুলোয় আমানতের প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে বাড়েনি, বরং কমেছে। গত জুনে ব্যাংকগুলোয় আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা কমে ৬ দশমিক ৪২ শতাংশে দঁাড়িয়েছে। ব্যাংক খাতের ওপর গ্রাহকদের আস্থা হ্রাসের কারণে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার কমতে পারে। এছাড়া কয়েকটি ব্যাংকের অবনতিশীল অবস্থার পাশাপাশি ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। এতে পরিবারের ব্যয়নির্বাহ করতে ভোক্তাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এসব কারণে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার কমেছে।
গত জুনে ব্যাংক খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা কমে এসেছে ৯ দশমিক ১৬ শতাংশে। সুদের হার বাড়ায় ঋণ গ্রহণের খরচ বেড়েছে বেশি। এতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। এছাড়া জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বাধাগ্রস্ত হয়েছে ব্যবসায়িক পরিবেশ, পাশাপাশি খেলাপি ঋণ এবং আমানতকারীদের টাকা উত্তোলনের ফলে কিছু ব্যাংক তারল্য সংকট বেড়েছে। এতে ঋণ বিতরণ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় এ খাতে প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং বাংলাশে ব্যাংক এ খাতের সংকট উত্তরণ এবং দীর্ঘমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ব্যাপক সংস্কার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ছয় সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। ব্যাংক খাতকে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য টাস্কফোর্সকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তারা সে আলোকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান নিরূপণ করতে টাস্কফোর্স উদ্যোগে গ্রহণ করেছে।