ব্রিটেনের দীর্ঘতম রাজত্বকারী শাসক ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তাঁর রাজত্বকাল জুড়ে ছিল কঠোর কর্তব্যপরায়ণতা ।
এছাড়া ব্রিটিশ সিংহাসন ও ব্রিটিশ জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁর জীবনকে নিবেদন করার ব্যাপারে তাঁর নিষ্ঠা ও অঙ্গীকার।
দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে যখন ব্রিটেনের প্রভাব ক্রমশ কমেছে, সমাজে আমূল পরিবর্তন এসেছে, রাজতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তখনও অনেকের কাছে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন একজন ধ্রুবতারা। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য রানির বর্ণাঢ্য জীবনের কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো-
এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ সালের ২১শে এপ্রিল। তাঁর বাবা অ্যালবার্ট, ডিউক অফ ইয়র্ক এবং মা সাবেক লেডি এলিজাবেথ বোওজ -লিওন-এর তিনি ছিলেন প্রথম সন্তান। অ্যালবার্ট ছিলেন পঞ্চম জর্জের দ্বিতীয় সন্তান।
রাজা পঞ্চম জর্জ ১৯৩৬ সালে মারা যাবার পর তাঁর সর্বজ্যেষ্ঠ পুত্র ডেভিড, অষ্টম এডওয়ার্ড উপাধি পান।
তবে দুবার বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া মার্কিন এক ধনী রমণী ওয়ালিস সিম্পসনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় সে বছরের শেষ দিকেই তাঁকে সিংহাসন ত্যাগ করতে হয় ।
১৯৩৬ সালে এলিজাবেথের বাবা ডিউক অফ ইয়র্ক অনিচ্ছার সঙ্গে সিংহাসনে বসেন রাজা ষষ্ঠ জর্জ হিসাবে এবং তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠান কিশোরী এলিজাবেথকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে। পরে প্রিন্সেস এলিজাবেথ লিখেছিলেন ওই অনুষ্ঠান ছিল অসাধারণ সুন্দর।
ইউরোপে তখন উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। সেই পটভূমিতে নতুন রাজা ষষ্ঠ জর্জ, তাঁর স্ত্রী ও দুই কিশোরী কন্যাকে নিয়ে রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে উদ্যোগী হন।
সেসময় ১৯৩৯ সালে, ১৩ বছরের কিশোরী প্রিন্সেস এলিজাবেথ তার বাবা ও মা , রাজা ও রানির সঙ্গে গিয়েছিলেন ডার্টমাউথে রয়াল নেভাল কলেজে।
সেখানে এলিজাবেথ ও তাঁর বোন মার্গারেটের সঙ্গে প্রথম সাক্ষা ঘটে গ্রিসের যুবরাজ প্রিন্স ফিলিপের, যিনি ছিলেন তাঁদের দূর সম্পর্কের কাজিন।
সেটাই যে তাদের প্রথম সাক্ষাৎ ছিল তা নয়, তবে সেই প্রথম এলিজাবেথ, ফিলিপ সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
এলিজাবেথের বয়স যখন ১৮, তখন ১৯৪৪ সালে ফিলিপের প্রতি তাঁর প্রণয় গভীর হয়ে ওঠে। তিনি ঘরে ফিলিপের ছবি রাখতেন, দুজন দুজনকে চিঠি লিখতেন।
১৯৪৭ সালের ২০শে নভেম্বর এলিজাবেথ ও ফিলিপ ওয়েস্টমিনস্টার গির্জায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফিলিপের উপাধি হয় ডিউক অফ এডিনবারা। তিনি নৌবৈাহিনীর কর্মকর্তা পদেই বহাল থাকেন।
বিয়ের পর ফিলিপ নৌবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে মল্টায় যান এবং বিয়ের প্রথম কয়েক বছর তাঁরা স্বাভাবিক বিবাহিত জীবন কাটান।
এ সময়ই তাঁদের প্রথম পুত্র চার্লসের জন্ম হয় ১৯৪৮ সালে এবং ১৯৫০ সালে জন্ম হয় কন্যা অ্যানের।
১৯৫২ সালে যখন এলিজাবেথের বয়স ২৫, তখন রাজা ষষ্ঠ জর্জ ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শয্যা নেন। একদিকে ছিল যুদ্ধের বছরগুলোর অতিরিক্ত চাপ, সেইসঙ্গে রাজা চিরকাল খুব বেশি ধূমপান করতেন।
এলিজাবেথ তাঁর স্বামীকে নিয়ে সেবছর বিদেশ সফরে যান বাবার হয়ে দায়িত্ব পালন করতে। এলিজাবেথের বয়স তখন ২৫। চিকিৎসকের পরামর্শ উপেক্ষা করে রাজা তাঁকে বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন। সেটাই ছিল পিতা ও কন্যার শেষ সাক্ষাত।
এলিজাবেথ কেনিয়ায় বসে পিতার মৃত্যু সংবাদ পান। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসেন তিনি ব্রিটেনের রানি হিসাবে। সেই মুহূর্তের কথা স্মরণ করে তিনি বলেছিলেন, এক অর্থে আমার কোনো শিক্ষানবিশী হয় নি। আমার বাবা মারা যান খুব অল্প বয়সে। কাজেই অনেকটা হঠাৎ করেই দায়িত্ব নিতে এবং সাধ্যমত দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী হতে হয়েছিল আমাকে।
১৯৫৩ সালের জুন মাসে আনুষ্ঠানিক অভিষেক অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসন আরোহণ ও শপথ গ্রহণ লাখ লাখ মানুষ দেখেন টেলিভিশনের পর্দায়। যদিও সেসময় প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এই অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচারের বিরোধিতা করেছিলেন।
যুদ্ধের পর ব্রিটেন তখন কঠিন অর্থনৈতিক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ উপনিবেশ তখন গুটিয়ে এসেছে। নতুন রানির দায়িত্ব নিয়ে তিনি যখন ১৯৫৩ সালে কমনওয়েলথ দেশগুলোতে দীর্ঘ সফরে বেরলেন, তখন ভারতীয় উপমহাদেশ সহ অনেক দেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে।
রানি এলিজাবেথ ছিলেন প্রথম ব্রিটিশ রাজশাসক যিনি অস্টেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সফর করেন। অনুমান করা হয় তাঁকে সামনাসামনি দেখতে অস্ট্রেলিয়ার এক তৃতীয়াংশ মানুষ রাস্তায় ভেঙে পড়েছিল।
ক্রমশ রাজতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের অবিচ্ছিন্ন আনুগত্যে বদল আসতে শুরু করে। সমাজের মধ্যে নানা ধ্যানধারনাও দ্রুত বদলাতে থাকে।
১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে, বাকিংহাম প্রাসাদ সিদ্ধান্ত নেয় যে রাজপরিবারকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। রানি এবং তাঁর পরিবারও যে আর পাঁচটা সাধারণ পরিবারের মত ঘরকন্নার নানা কাজ করেন তা দেখাতে বিবিসিকে ‘রয়াল ফ্যামিলি’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়।
রানির দৈনন্দিন ঘরসংসারের নানা ছবি ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। অনেকে বলেন ওই তথ্যচিত্র রাজপরিবারের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা ও ভালবাসা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে, তবে সমালোচকরা কেউ কেউ বলেন রাজপরিবারকে নিয়ে মানুষের মনে যে দীর্ঘদিন একটা রহস্য ও রোমাঞ্চ ছিল এই ছবি তা ধ্বংস করে দেয়।
রানি এলিজাবেথ তাঁর দায়িত্ব পালনে নানা দেশে ভ্রমণ অব্যাহত রাখেন। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্রিটিশ রানি যিনি অ্যামেরিকান কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেন।
এর এক বছরের মধ্যে তাঁর পরিবারে নানা ধরনের কেলেংকারি ও দুর্যোগের ঘটনা শুরু হয়। রানির দ্বিতীয় ছেলে ডিউক অফ ইয়র্ক ও স্ত্রী সারা আলাদা হয়ে যান।
মেয়ে প্রিন্সেস অ্যান ও স্বামী মার্ক ফিলিপস্-এর বিয়ে ভেঙে যায়। প্রিন্স ও প্রিন্সেস অফ ওয়েলস্, অর্থাৎ চালর্স ও ডায়ানা বিয়েতে যে গভীরভাবে অসুখী এ খবর জানাজানি হয় । তারাও আলাদা হয়ে যান।
রানির প্রিয় বাসভবন উইন্ডসর কাসেলে ওই বছরই বিরাট অগ্নিকাণ্ড হয়। ওই ভবন মেরামতের খরচ সাধারণ মানুষ জোগাবে নাকি তা রানির তহবিল থেকে ব্যয় করা উচিত তা নিয়ে চলে তুমুল বিতর্ক।
রানি ১৯৯২ সালকে ব্যাখ্যা করেন দুর্যোগের বছর হিসেবে।
একদিকে ইউরোপের সঙ্গে নতুন জোট গঠনের মধ্যে দিয়ে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ব্রিটেনের যোগাযোগ কিছুটা শিথিল হয়ে আসা, অন্যদিকে ব্রিটেনে রাজতন্ত্রের ভবিষ্যত নিয়ে জনমনে অব্যাহত বিতর্ক- এর মধ্যেও যখন রানি রাজপরিবারের উজ্জ্বল স্তম্ভ হিসাবে তাঁর দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট, তখন প্রিন্সেস ডায়ানার আকস্মিক মৃত্যু ব্রিটেনের রাজপরিবারের জন্য বড়ধরনের ধাক্কা হয়ে আসে।
১৯৯৭ সালের অগাস্টে প্যারিসে গাড়ি দুর্ঘটনায় ডায়ানা মারা যাবার পর রানির বিরুদ্ধে ওঠে সমালোচনার ঝড়। যখন প্রাসাদের বাইরে বিশাল মানুষের ঢল- ফুলের শ্রদ্ধার্ঘ্যে ভরে উঠেছে প্রাসাদের ফটকের বাইরের রাস্তাঘাট, তখন সেই শোকের মুহূর্তের সঙ্গে রানির আপাতদৃষ্টিতে একাত্ম হতে না পারায় মানুষ সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।
মানুষের উত্তাল সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত রানিকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে হয়- যে ভাষণে তিনি পুত্রবধূ ডায়ানার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন এবং সময়ের সাথে রাজ-পরিবারকে বদলানোর অঙ্গীকার দেন।
রাজপরিবারের প্রতি ব্রিটেনের মানুষের আগ্রহ, উদ্দীপনা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ২০০২ সালে মহাসমারোহে উদযাপিত হয় রানির সিংহাসন আরোহণের সুবর্ণ জয়ন্তী, এরপর রানির ৮০ বছরের জন্মদিনে উইন্ডসরের রাস্তায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সাক্ষাত-সফর, রানি ও প্রিন্স ফিলিপের বিয়ের ৬০তম বার্ষিকী উৎসব, এবং ২০১১ সালে রানির নাতি উইলিয়াম ও ক্যাথরিনের বিয়ে ও ২০১২সালে রানির সিংহাসন আরোহণের হীরক জয়ন্তী উদযাপন করা হয়। ২০১৬ সালে রানি তাঁর ৯০ বছরের জন্মদিন পালন করেন। নব্বই বছর পার করেও তিনি তাঁর রাজ দায়িত্ব চালিয়ে গেছেন। ২০১৭ সালে তাঁর স্বামী ডিউক অফ এডিনবারা, প্রিন্স ফিলিপ অবসর নেবার পরেই তিনি একাই তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন।
রানির দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গী প্রিন্স ফিলিপ প্রয়াত হন ২০২১-এর এপ্রিল মাসে।
চলতি বছর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন রানি এলিজাবেথ।
সবশেষ ২০২২-এর জুন মাসে মহা সমারোহে উদযাপিত হয়েছে রানির সিংহাসন আরোহণের ৭০তম বার্ষিকী বা প্লাটিনাম জয়ন্তী।
সূত্র: এনডিটিভি,বিবিসি