২০২২ বিশ্বকাপ কাতারে আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকেই প্রবাসীদের নিয়ে আলোচনা চলছে। দেশটি প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে বহু দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে বিভিন্ন সংগঠন। ইতিমধ্যে রাজধানী দোহায় প্রবাসী শ্রমিকদের আবাসস্থল থেকে উচ্ছেদ করতে শুরু করেছে দেশটির সরকার।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্স-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে দেশটিতে আসা পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করতে দোহার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকগুলো খালি করছে কর্তৃপক্ষ।
উচ্ছেদের শিকার শ্রমিকরা রয়টার্স-কে জানিয়েছেন, কয়েক ডজন ভবন খালি করে তালা মেরে দিয়েছে মিউনিসিপ্যালিটি কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে প্রবাসী শ্রমিক বিশেষ করে এশিয়ান ও আফ্রিকানদের জোর করে বের করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি তাদের থাকার জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থাও করা হয়নি। অনেকে বাধ্য হয়ে তালাবদ্ধ বাড়িগুলোর সামনে বিছানা বিছিয়ে কোনোমতে রাত পার করেছেন।
বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র ৪ সপ্তাহ আগে শ্রমিকদের সঙ্গে এমন আচরণ করায় ফের সমালোচনার মুখে পড়েছে কাতার। এমনিতে শুরু থেকেই কাতার বিশ্বকাপ আছে নানা প্রশ্নের মুখে। সবকিছুই প্রায় নতুন করে করতে হয়েছে তাদের, নির্মাণ হয়েছে বেশ কয়েকটি নতুন স্টেডিয়াম। এসব কাজে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার শ্রমিক মারা যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সমকামীদের জন্য কাতারের আইন নিয়েও রয়েছে সমালোচনা। এবার তাতে যোগ হলো নতুন মাত্রা।
দোহার আল মানসুরা জেলায় সদ্য খালি করা হয়েছে এমন এক ভবনের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ওই ভবনে ১২ শ মানুষ থাকতেন। গত বুধবার রাতে হুট করে বাসিন্দাদের ভবন খালি করতে ২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয় মিউনিসিপ্যালিটি কর্তৃপক্ষ। আড়াই ঘণ্টা পর মিউনিসিপ্যালিটির কর্মকর্তারা ফিরে আসেন এবং জোর করে সবাইকে বাইরে বের করে দিয়ে দরজায় তালা মেরে দেন। বাসিন্দাদের দাবি, অনেকে সময়মতো ফিরে নিজেদের জিনিসপত্রও সরিয়ে নিতে পারেননি।
উচ্ছেদের শিকার এক ব্যক্তি রয়টার্স-কে বলেছেন, ‘আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। ‘ একথা বলার সময় ওই ব্যক্তি প্রায় ১০ জনের সঙ্গে বাড়ির বাইরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তার সঙ্গে থাকা কারো কারো গায়ে শরতের তাপ এবং আর্দ্রতার মাঝেও শার্ট পর্যন্ত ছিল না। তবে কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষু এড়াতে তারা কেউ রয়টার্সকে নিজেদের নাম ও ব্যক্তিগত তথ্য দিতে অস্বীকার করেন।
কাছেই পাঁচ ব্যক্তি একটি ম্যাট্রেস ও ছোট ফ্রিজ পিকআপ ট্র্যাকে তুলছিলেন। তারা প্রতিবেদককে জানান, দোহা থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত সুমায়সিমাহ এলাকায় একটি রুম খুঁজে পেয়েছেন।
এদিকে উচ্ছেদের ব্যাপারে জানতে চাইলে কাতারের সরকারি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, বিশ্বকাপের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই এবং দোহার এলাকাগুলোতে দীর্ঘমেয়াদী পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অংশ। তাদের (যাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে) নিরাপদ ও সঠিক জায়গায় পুনর্বাসন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ফিফা এবং কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজকদের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
কাতারের মোট জনসংখ্যা মাত্র ৩০ লাখ, যার ৮৫ শতাংশই প্রবাসী শ্রমিক। উচ্ছেদের শিকার হওয়া শ্রমিকদের অধিকাংশই ড্রাইভার কিংবা দিনমজুর। এছাড়া যাদের সঙ্গে কোম্পানিগুলোর চুক্তি আছে ঠিকই কিন্তু থাকার ব্যবস্থা নিজের- এমন শ্রমিকদের এমন ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়েছে। তবে নির্মাণ সংস্থাগুলোতে যারা কাজ করেন তারা কোম্পানিগুলোর নিজস্ব ক্যাম্পে বসবাস করেন।
এক শ্রমিক জানিয়েছেন, মূলত একক ব্যক্তি যারা তাদেরকেই উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু যে শ্রমিকরা পরিবারসহ বাস করেন তাদের উচ্ছেদের শিকার হতে হয়নি। রয়টার্স-এর প্রতিবেদক বেশ কয়েকটি ভবনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে উচ্ছেদের ব্যাপারটি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। এমনকি কয়েকটি ভবনের বিদ্যুত সংযোগও নাকি বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
রয়টার্স-এর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ওই ভবনগুলোর প্রায় সবগুলোই বিশ্বকাপ উপলক্ষে ভাড়া নিয়েছে কাতারি সরকার। আয়োজকদের ওয়েবসাইটে আল মানসুরা ও অন্যান্য জেলায় অবস্থিত অনেকগুলো ভবনের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এই ভবনগুলোর একেকটি ফ্ল্যাটে ভাড়া প্রতি রাত ২৪০ থেকে ৪২৬ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে।
কাতার সরকারের পক্ষ থেকে রয়টার্স-কে জানানো হয়েছে, ২০১০ সালে পাস হওয়া একটি আইন বাস্তবায়ন করছে দোহা মিউনিসিপ্যালিটি কর্তৃপক্ষ। এই আইনে শ্রমিকদের সপরিবার আবাসিক এলাকাগুলোতে বসবাস করতে বাধা দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এমনকি এই আইনে অনাবাসী মানুষজনকে আবাসস্থল থেকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে।
উচ্ছেদের শিকার শ্রমিকদের অনেকে তাদের কর্মস্থলের কাছাকাছি থাকার জন্যই ওই ভবনগুলোকে বেছে নিয়েছিলেন। এখন উচ্ছেদ করার পর তাদের অনেকটা দূরে গিয়ে থাকার জায়গা খুঁজতে হচ্ছে। অনেক শ্রমিক দাবি করেছেন, তাদের একবার নয়, কয়েকবার উচ্ছেদের শিকার হতে হয়েছে। তাদের একজন জানিয়েছেন, গত সেপ্টেম্বরের শেষদিকে তাকে আল মানসুরার একটি ভবন ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এর ১১ দিন পর কোনো পূর্ব নোটিশ ছাড়াই তিনিসহ আরও ৪০০ জনকে পরবর্তী ভবন থেকেও বের করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক মোহাম্মদ জানিয়েছেন, একটি ভবনে ১৪ বছর ধরে বসবাস করছিলেন তিনি। কিন্তু গত বুধবার মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন তাকে সহ আরও ৩৮ জন বাসিন্দাকে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয় বাড়ি ছাড়ার জন্য। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে কাতার বিশ্বকাপের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হলো, টুর্নামেন্টের সময় ঘনিয়ে আসতেই তাদেরকে ছুড়ে ফেলা শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ‘স্টেডিয়ামগুলো কারা নির্মাণ করলো? রাস্তাঘাট কারা বানালো? সবকিছু কারা বানালো? বাঙালি, পাকিস্তানিরা। আমাদের মতো লোকজন। এখন তারা আমাদের বাইরে বের করে দিচ্ছে।’ সূত্র: রয়টার্স