নিজস্ব প্রতিবেদক
২৮ আগস্ট কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়া গণহত্যা দিবস উপলক্ষে শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। রবিবার বিকেলে শহরের ছয় রাস্তা মোড়ের রোটারী ফিজিওথেরাপি সেন্টারে এ আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
শহীদ পরিবার, কুষ্টিয়া’র আহবায়ক
শামসুজ্জামান সাদীর সভাপতিত্বে এবং শহীদ পরিবার, কুষ্টিয়া’র সদস্য সচিব ও কুষ্টিয়া সিটি কলেজের শিক্ষক ওবায়দুর রহমানের সঞ্চালনায়
প্রধান অতিথি ছিলেন কুষ্টিয়া সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বিজ্ঞ জিপি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাড আ স ম আক্তারুজ্জামান মাসুম। এসময় বিশেষ অতিথি ছিলেন লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা,সমাজসেবা অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক নজরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক এসএম কাদেরী শাকিল। অনুষ্ঠানে গণহত্যা বিষয়ের উপর বক্তব্য রাখেন রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও গবেষক ইমাম মেহেদী, রোটারি ক্লাব অব কুষ্টিয়ার সৈয়দা হাবিবা ও সেক্রেটারি তুষার রতন।
এসময় একাত্তরে গণহত্যার নির্মম ইতিহাস ও পরিবারের সদস্য হারানোর বেদনা বর্ণনা করে বক্তব্য রাখেন শহীদ পরিবারের সদস্য রফিকুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, তপন বিশ্বাস।
বক্তারা বলেন, পাকিস্তানিদের সহযোগী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের চক্রান্তে আগস্টের ২৮ তারিখ রাতে থানাপাড়ার বিভিন্ন বাড়ি থেকে আট–দশজন যুবককে ধরে এনে ছয় রাস্তার মোড়ে জড়ো করা হয়। এঁদের অনেকেই এপ্রিল থেকে এযাবৎ গ্রামে গ্রামে কাটিয়েছেন। আবার কেউ বন্যার কারণে, কেউ ফেলে যাওয়া ঘরবাড়ির দেখাশোনার জন্য শহরে এসেছিলেন। ছয় রাস্তার মোড়ের কাছেই আবদুস সবুর নামে একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। যুদ্ধের আগের বছর পরিবহন ব্যবসা শুরু করেন। ট্রাক ছিল তাঁর। ট্রাকের দুজন শ্রমিকসহ তাঁকে হত্যা করা হয়। শ্রমিক দুজনের নাম–ঠিকানা জানা যায়নি। ভেড়ামারা হাইস্কুলের তরুণ বিজ্ঞান শিক্ষক কামাল উদ্দিন শেখ ফেরত এসেছিলেন মেহেরপুর থেকে। সঙ্গে তাঁর এক শিশু বয়সী ভাই নুরুল ইসলাম শেখ। উদ্দেশ্য ছিল ছয় রাস্তার মোড়ের তাঁদের বাড়িটা রক্ষা করা আর পরিস্থিতি বুঝে একে একে পরিবারের অন্য সদস্যদের ফিরিয়ে আনা। এই দুই ভাইকেও হত্যা করা হয় সেই রাতে। তাঁদের পিতা নাজির আহমেদ শেখ ছিলেন কুষ্টিয়া সদর মহকুমা অফিসের প্রধান সহকারী।
অবিভক্ত নদীয়া জেলার নির্বাচিত জেলা পরিষদ সভাপতি এবং পরবর্তী সময়ে কুষ্টিয়া জেলার জি পি খানবাহাদুর শামসুজ্জহার পুত্র ব্যবসায়ী ওবায়দুর রহমান বুলু একাই বাড়ির দেখাশোনা আর বকেয়া কিছু কাজ করার জন্য গ্রাম থেকে শহরের বাড়িতে এসেছিলেন। তাঁকেও সে রাতে ধরে নিয়ে আসে হানাদারদের দোসর উর্দুভাষী আর জামাতিরা। তাঁর পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তাঁদের প্রতিবেশী কুষ্টিয়া শহর রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার এবং ‘পাক রেস্তোরাঁর’ মালিক উর্দুভাষী নেসার খাঁ এবং কুষ্টিয়া শান্তি কমিটির প্রধান সাদ আহমদ সেই রাতে ছয় রাস্তার মোড়ে অবস্থান করে হত্যার দিকনির্দেশনা দেন। এই নেসারই ওবায়দুর রহমান বুলুকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যান। এ ঘটনার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন তাঁর ছোট ভাই, তখন মেডিকেল ছাত্র শওকত হায়াত শ্যামা। ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে নেসারদের হাতে ধরা পড়ার আগেই ছোট ভাইকে অন্য দরজা দিয়ে বের করে দেন। শওকত হায়াত পাশের বাসায় আশ্রয় নিয়ে বেঁচে যান। বলে রাখা ভালো, থানাপাড়া গণহত্যার হোতা সাদ আহমদ তরুণ বয়সে শহীদ ওবায়দুর রহমান বুলুর পিতা খান বাহাদুর শামসুজ্জহার হাত ধরে তাঁদেরই বাড়িতে থেকে আইন ব্যবসার প্রাথমিক তালিম পেয়েছিলেন।
শহরের প্রধান সড়ক হাই রোডের আমতলার কেরোসিন বিক্রেতা তরুণ দিনু ওরফে দিন মহাম্মদকেও সেদিন উঠিয়ে নিয়ে আসে তারা। শেষ পর্যন্ত দিনুকে তারা সারা রাত আটকে রেখে ছেড়ে দিলেও বাকিদের জিকের ঘাটে (যেখানে এখন শেখ রাসেল সেতু নির্মিত হয়েছে) নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে গড়াই নদে ফেলে দেয়। তাঁদের লাশের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। দিনুর বয়ান অনুযায়ী, কুষ্টিয়ার তৎকালীন জামায়াত নেতা মহিউদ্দিন ওই হত্যাকারীদের সঙ্গে ছিল। তাঁকেসহ সাতজনকে যখন নদীর ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ঘাটে বাঁধা জ্বালানি কাঠ (খড়ি)-এর নৌকার লোকজন জেগে গেলে নৌকায় থাকা তিনজনকে একসঙ্গে হত্যা করা হয়, নৌকার অন্য দুজন পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে গুলির হাত থেকে বাঁচলেও তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা জানা যায়নি।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের ২৮ আগস্ট থানাপাড়া গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালে এই দিন রাতে রাজাকারদের হাতে শহরের থানাপাড়া জিকে ঘাটে ১০ জন নির্মমভাবে শহীদ হন। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবদুস সবুর, শিক্ষক কামাল উদ্দিন শেখ, কিশোর নূরুল ইসলাম শুকু, ওবায়েদ রহিম বুলু ও আক্কেল মোল্লা ঐদিন রাতে রাজাকারদের হাতে প্রাণ হারান। অবশিষ্ট পাঁচজনের পরিচয় আজও জানা যায়নি।
এর আগে, শহীদ পরিবার, কুষ্টিয়া’র সদস্য সচিব মোঃ ওবাইদুর রহমান ও নির্বাহী সদস্য মোঃ শহিদুল ইসলাম দিপু গতকাল কুষ্টিয়া পৌরসভার মেয়র আনোয়ার আলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ রবিউল ইসলামের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতকালে শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে তারা “শহীদ স্মৃতি সড়ক” নামে একটি সড়কের নামকরণ ও সেখানে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি নামফলক স্থাপনের অনুরোধ জানান।
আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে শহীদদের স্মরণে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।