ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর শিশুদেরকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে মুখে খাবার নয়, ঘুমের ওষুধ তুলে দিচ্ছেন আফগানরা। কেউ কেউ খাবার কিনতে অর্থের জন্য বিক্রি করে দিচ্ছেন দেহের অঙ্গ কিংবা মেয়েকে। তালেবানের অধীনে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষদের এমনই দুরবস্থা। দেশটির লাখ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সরকারকে উৎখাত করে দ্বিতীয়বারের মত আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে তালেবান। মানবাধিকারের নানা ইস্যুতে তালেবানকে বাধ্য করতে দেশটির জন্য বারাদ্দ বিদেশি তহবিল আটকে দেয়া হয়েছে বলে বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
তাতে সবচেয়ে বিপদে পড়েছে দেশটির দরিদ্র জনগোষ্ঠী। যারা দীর্ঘদিন ধরে নানা বিদেশি ত্রাণের উপর জীবন নির্বাহ করছিল। এমনই একজন আব্দুল ওহাব। তিনি বলেন, আমাদের শিশুরা কাঁদতেই থাকে, ক্ষুধার যন্ত্রণায় তারা এমনকী ঘুমায় না পর্যন্ত। কিন্তু আমাদের কাছে কোনও খাবার নেই। তাই আমরা ওষুধের দোকানে গিয়ে ট্যাবলেট কিনে এনে তাদের খেতে দেই। ওষুধ খেয়ে তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে থাকে।
হেরাত নগরীর ঠিক বাইরেই একটি আশ্রয়কেন্দ্রে বাস আব্দুলের। হেরাত দেশটির তৃতীয় বৃহৎ নগরী। ওহাব যে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকেন সেখানে ছোট ছোট মাটির ঘরে দশকের পর দশক ধরে যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৃহহীন মানুষরা আশ্রয় নিয়ে আছে। বিবিসির করা এক প্রশ্ন জবাবে আব্দুলের বলেন, আমাদের অনেকে, আমাদের প্রায় সবাই শিশুদের শান্ত রাখতে ওষুধ খাওয়ান।
তাদের একজন গুলাম হজরত তার জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে ওষুধের একটি পাতা বের করে আনেন। সেটি ছিল ‘আলপ্রাজোলাম’। অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার বা উদ্বেগজনিত মনোরোগের চিকিৎসায় এই ওষুধ ব্যবহার হয়। ছয় সন্তানের বাবা গুলামের ছোটটির বয়স এক বছর। তিনি বলেন, আমি এমনকী তাকেও ওষুধ দেই।
অন্যদের কারো কারো পকেট থেকে নার্ভ শিথীল করার অন্যান্য ওষুধ বের হয়েছে। যেগুলো মূলত বিষন্নতা ও উদ্বেগের মত মনোরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ক্ষুধার্ত শিশুদের এসব ওষুধ দেয়ার কারণে তাদের লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকী মাথাঘোরা, ঝিমুনি এবং আচরণে অস্বাভাবিকতাও দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
আফগানিস্তানের যে কয়টি পরিবারের সঙ্গে বিবিসি কথা বলেছে তারা প্রতিদিন মাত্র কয়েকটি রুটি ভাগ করে খায়। এক নারি বলেন, তারা সকালে শুকনো রুটি খান এবং রাতে সেগুলো পানিতে ভিজিয়ে রাখেন যেন নরম হয়।
জাতিসংঘ থেকেও আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, দেশটিতে মানবিক ‘বিপর্যয়’ শুরু হয়ে গেছে।
গত বছর অগাস্টে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কোনো মহল তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। দেশটির জন্য বরাদ্দ বৈদিশিক তহবিলও আটকে দেয়া হয়েছে। যার ফলে দেশটির নাজুক অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এখন বেশিরভাগ দিনমজুরই প্রতিদিন কাজ পান না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিবিসিকে জানান, তিনমাস আগে তিনি কিডনি বিক্রি করেছেন। জামা তুলে তিনি তার পেটের কাঁটা দাগ দেখান। যেটি এখনো পুরোপুরি শুকায়নি। তার বয়স কুড়ির কোটায়। তিনি জানেন না তার জন্য ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে।
তিনি বলেন, কোনো উপায় ছিল না। আমি শুনেছিলাম স্থানীয় একটি হাসপাতালে কিডনি বিক্রি করা যায়। আমি সেখানে যাই এবং আমার কিডনি বিক্রি করতে চাই। কয়েক সপ্তাহ পর আমি একটি ফোন পাই এবং আমাকে হাসপাতালে যেতে বলে। তারা প্রথমে কিছু পরীক্ষা করে। তারপর আমাকে অজ্ঞান করার ইনজেকশন দেয়। আমি আতঙ্কে ছিলাম। কিন্তু আমার কাছে বিকল্প কোনো উপায় ছিল না।
কিডনি বিক্রি করে দুই লাখ ৭০ হাজার আফগানি পেয়েছিলেন ওই তরুণ। যার বেশিরভাগই ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়ে গেছে। পরিবারের জন্য খাবার কিনতে তিনি ওই ঋণ করেছিলেন। যদি আমরা একরাত খাই তবে পরের রাত না খেয়ে থাকি। কিডনি বিক্রির পর আমার মনে হয় আমি অর্ধেক মানুষ। আমি খুবই হতাশ। যদি জীবন এভাবেই চলতে থাকে তবে আমার মনে হয় আমি মারা যাব।
অর্থের জন্য অঙ্গ বিক্রি অবশ্য আফগানিস্তানে নতুন নয়। তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের আগেও এমনটা চলে আসছিল। কিন্তু এখন এতটা যন্ত্রণাদায়ক পথ বেছে নিয়ে হলেও মানুষ টিকে থাকতে চাইছে।
আরেক মায়ের সঙ্গে দেখা হয় বিবিসি প্রতিনিধি দলের। যিনি সাত মাস আগে কিডনি বিক্রি করেছেন এবং তারও বেশিরভাগ অর্থ ঋণ পরিশোধেই গেছে। এখন তিনি তার দুই বছরের মেয়েকে বিক্রি করতে চাইছেন। তিনি বলেন, পাওনাদাররা আমাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করছে। তারা বলছে, যদি ঋণের অর্থ দিতে না পারি তবে যেন আমার মেয়েকে তাদের দিয়ে দেই।
ওই নারীর স্বামী বলেন, আমাদের অবস্থা দেখে আমি খুব লজ্জিত বোধ করি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।
ক্ষুধার কাছে ওইসব মানুষদের আত্মসম্মান পরাজিত হয়েছে। একটি গ্রামের প্রধান আব্দুল গাফফার বলেন, আমরা জানি এটা ইসলাম বিরোধী এবং আমরা আমাদের শিশুসন্তানদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলছি। কিন্তু আমাদের কাছে বিকল্প কোনো পথ নেই।
নাজিয়া নামে চার বছরের একটি মেয়ের বাবা তাকে বিক্রি করবেন বলে মসজিদে ঘোষণা দিয়েছেন। নাজিয়াকে দক্ষিণের কান্দাহার প্রদেশের একটি পরিবার তাদের ১৪ বছর বয়সের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবে বলে কিনে নিয়েছে। নাজিয়া ১৪ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত তার বাবার বাড়িতে থাকতে পারবে। ওই সময়ে তারা বাবা দুইবার কিস্তিতে অর্থ পাবেন।