গাজায় সর্বাত্মক সেনা হামলার যে ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল, তার আগে উত্তর গাজায় ইসরায়েলের সীমানার কাছে বিপুল সংখ্যায় সৈন্য জড়ো হয়েছে। উত্তর গাজার কাছে ইসরায়েলের বসানো কাঁটাতারের সীমানার ১০ থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে আশকেলনে অবস্থান নিয়েছে এই ইসরায়েলি সেনারা।
সেনা অবস্থান ছাড়াও যুদ্ধবিমান আসা যাওয়া ও নজরদারি ড্রোন চলাচলের মত নানা ঘটনা ঘটছে সেখানে। ইসরায়েলের বেশ কিছু যুদ্ধবিমান গাজার দিকে ক্রমাগত যাওয়া আসা করছে। তবে এই অঞ্চলে বিমানের উপস্থিতি বাড়ানোর কারণ এখনো নিশ্চিতভাবে বোঝা যাচ্ছে না। যদিও শনিবার সারারাতই গাজা এলাকায় বিমান হামলা হয়েছে।
ইসরায়েল এরই মধ্যে তাদের রিজার্ভে থাকা কয়েক লাখ সৈন্যকে সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত করেছে। গাজার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অনেক ট্যাঙ্কও অবস্থান নিয়েছে বলে বলা হচ্ছে।
শনিবার ঐ অঞ্চলে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ও প্রস্তুতি দেখতে গিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মন্তব্য করেছেন, সংঘাতের পরের পর্ব আসছে।
এর আগে গত সপ্তাহে হামাসের আকস্মিক হামলার পর তিনি এক ভিডিও বার্তায় হুমকি দিয়েছিলেন যে ইসরায়েলি বাহিনী ‘পৃথিবী থেকে হামাসকে নিশ্চিহ্ন’ করে ফেলবে।
ইসরায়েলি বাহিনী গত দুদিন ধরে গাজায় সর্বাত্মক হামলার হুমকি দিতে থাকলেও কখন এই হামলা শুরু হবে তা এখনো চূড়ান্তভাবে জানায়নি।
উত্তর গাজায় হামাস ঘাঁটিতে হামলা করার আগে সেখান থেকে বেসামরিক বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার জন্য কয়েক দফায় সময়ও বেঁধে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে গাজার বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার সময়
গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বেসামরিক বাসিন্দাদের দক্ষিণে সরে যেতে শুক্রবার নির্দেশনা দিয়েছিল ইসরায়েলি বাহিনী। ঐ সময়সীমা পার হওয়ার পর শনিবার আরো ছয় ঘণ্টা সময় দেয়া হয় দুটি নির্দিষ্ট রাস্তা ব্যবহার করে উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণে সরে যাওয়ার জন্য।
এরপর রবিবার সকালে আবারো তিন ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়া হয় বেসামরিক বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার জন্য। প্রাথমিকভাবে এই সময়সীমা ছিল স্থানীয় সময় দুপুর একটা (বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টা) পর্যন্ত। তবে সবশেষ খবর পর্যন্ত তারা আরো ৪০ মিনিট বাড়িয়েছে এই সময়সীমা।
বেসামরিক বাসিন্দাদের পাশাপাশি এই সময়ের মধ্যে উত্তর গাজার হাসপাতালগুলো খালি করারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ইসরায়েলি সেনাদের পক্ষ থেকে। কিন্তু ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট কমিটি শনিবারই জানিয়ে দেয় যে তারা অসুস্থ ও আহতদের সেবা দিতে থাকায় হাসপাতাল খালি করে যেতে পারবে না।
দাতব্য সেবা সংস্থা মেডিসাঁ সাঁ ফ্রঁতিয়ের নির্বাহী পরিচালক ডা. নাটালি রবার্টস মন্তব্য করেছেন যে কয়েক ঘণ্টার নোটিশে গাজার হাসপাতাল থেকে সরে যাওয়া ‘অসম্ভব।’ তিনি বলছেন, তাদের যাওয়ার কোনো জায়গাই নেই। গাজার দক্ষিণের হাসপাতালগুলো সম্পূর্ণ ভরে গেছে। তাছাড়া পুরো গাজাতেই এখন কোনো বিদ্যুৎ নেই।
এছাড়াও দক্ষিণ গাজার হাসপাতালগুলোতে রোগীদের স্থান সঙ্কুলান করাও কঠিন হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
হাসপাতাল খালি করার নির্দেশনাকে রোগীদের জন্য ‘মৃত্যুদণ্ড’এর শামিল হিসেবে মন্তব্য করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে গত শনিবার ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় ২৮ জন চিকিৎসা সেবাদানকারী মারা গেছে।
তারা আরো জানিয়েছে যে, গাজার দুটি হাসপাতালে কোনো সেবা দেয়া যাচ্ছে না এবং ১৫টি মেডিকেল সেন্টার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রণতরী, ইরানের হুমকি
যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ভূমধ্যসাগরে যুদ্ধবিমান বহনকারী আরেকটি রণতরী ‘ইউএসএস আইজেনহাওয়ার’ পাঠিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লয়েড অস্টিন শনিবার জানান যে ‘ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হামলা স্তিমিত করতে ও হামাসের হামলাকে ঘিরে ঐ অঞ্চলে যুদ্ধের বিস্তার থামাতে’ এই রণতরী পাঠানো হয়েছে।
গত সপ্তাহে হামাস ও ইসরায়েলি বাহিনীর এই সংঘাত শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ভূমধ্যসাগরে একটি রণতরী পাঠায়। নতুন পাঠানো রণতরী ইউএসএস আইজেনহাওয়ার আগে থেকে অবস্থান করা রণতরী ইউএসএস ফোর্ডের সাথে যোগ দেবে।
গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণে যেন বেসামরিক বাসিন্দারা হতাহত না হয়, সে বিষয়ে জোর দিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাথে শনিবার ফোনে আলোচনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
গাজায় বেসামরিক বাসিন্দাদের জন্য ত্রাণ ও জরুরি সেবা নিশ্চিত করার বিষয়ে বাইডেন প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন, পিএলও’র নেতা মাহমুদ আব্বাসের সাথেও ফোনে কথা বলেন।
অন্যদিকে গাজায় বেসামরিক বাসিন্দাদের ওপর ইসরায়েলের অভিযান অব্যাহত থাকলে ঐ অঞ্চলের ‘পরিস্থিতি একরকম থাকার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না’ বলে সতর্ক করেছে ইরান।
কাতারের রাজধানী দোহায় হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়ের সাথে দেখা করার পর ইরানের গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দোল্লাহিয়ান।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্স হামাসের এক বিবৃতির বরাত দিয়ে খবরে প্রকাশ করেছে যে হামাসের লক্ষ্য অর্জনে ইরান সহায়তা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের নৌকা দিয়ে সরে যাওয়ার নির্দেশ
ইসরায়েলের মার্কিন দূতাবাস যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও তাদের আত্মীয়দের সাগর পথে ইসরায়েল ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে।
উত্তর ইসরায়েলের হাইফা বন্দর থেকে সাগর পথে সাইপ্রাস যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেখানকার মার্কিন নাগরিকদের। হাইফা বন্দর থেকে সাইপ্রাসের লিমাসল বন্দরের সাগর পথে দূরত্ব প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা।
এর আগে শনিবার গাজায় অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের গাজার দক্ষিণের রাফাহ সীমানা পার করে মিশরে চলে যেতে আহ্বান জানায় যুক্তরাষ্ট্র।
সূত্র: বিবিসি বাংলা