ব্যস্ত যান্ত্রিক নগরীর একঘেয়েমী জীবন থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য খানিকটা স্বস্তি আর নিরিবিলি শান্ত পরিবেশে কিছুটা সময় পরিবার পরিজন কিংবা বন্ধুমহল কে নিয়ে কাটানোর উপযুক্ত দর্শনীয় স্থান হল পানাম নগর। সাপ্তাহিক যেকোন ছুটির দিনে ঘুরে আসতে পারেন প্রাচীন বাংলার পানাম সিটি। ইহিহাস এতিহ্য সর্ম্পকে যেমন জানতে পারবেন তেমনি ঐ সময়ের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী দেখে মুগ্ধ হবেন। চারপাশের সবুঝের আবহে নয়ন জুড়িয়ে যাবে। দুষণমুক্ত পরিবেশে নিশ্বাস নিতে পারবেন প্রাণ ভরে।
পানাম নগর নারায়ণগঞ্জ জেলার, সোনারগাঁতে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহর। বড় নগর, খাস নগর, পানাম নগর -প্রাচীন সোনারগাঁর এই তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিলো সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এখানে কয়েক শতাব্দী পুরনো অনেক ভবন রয়েছে, যা বাংলার বার ভূইয়াঁদের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। সোনারগাঁর ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই নগরী গড়ে ওঠে।
সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর থেকে উত্তর দিকে হাঁটাপথেই পৌঁছানো যায় অর্ধ্বচন্দ্রাকৃতি পানাম পুলে। (যদিও পুলটি ধ্বংস হয়ে গেছে)। পুলটির দৈর্ঘ্য ছিলো ৭২ ফুট আর প্রস্থ ছিলো ১৫.৫ ফুট, মাঝখানটা ছিলো উঁচু। এই পুল পেরিয়েই পানাম নগর এবং নগরী চিরে চলে যাওয়া পানাম সড়ক। আর সড়কের দুপাশে সারি সারি আবাসিক একতলা ও দ্বিতল বাড়িতে ভরপুর পানাম নগর।
ইতিহাসঃ
১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন সোনাগাঁওয়ে। পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসতো বিলাতি থানকাপড়, দেশ থেকে যেতো মসলিন। শীতলক্ষ্যা আর মেঘনার ঘাটে প্রতিদিনই ভিড়তো পালতোলা নৌকা। প্রায় ঐসময়ই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠে পানাম নগরী। পরবর্তিতে এই পোশাক বাণিজ্যের স্থান দখল করে নেয় নীল বাণিজ্য। ইংরেজরা এখানে বসিয়েছিলেন নীলের বাণিজ্যকেন্দ্র।
ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টার-এর অভিমত হলো, সুলতানী আমলে পানাম ছিলো সোনারগাঁর রাজধানী। কিন্তু পানামে, সুলতানী আমলের তেমন কোনো স্থাপত্য নজরে পড়ে না, তাই এই দাবিটির সত্যতা ঠিক প্রমাণিত নয়। এক্ষেত্রে জেম্স টেলর বলেছেন, সোনারগাঁর প্রাচীন শহর ছিলো পানাম। এই তত্ত্বটির সাথে বাস্তবের কোনো বিরোধ নেই। শহরটিতে ঔপনিবেশিক ধাঁচের দোতলা এবং একতলা বাড়ি রয়েছে প্রচুর। যার বেশিরভাগ বাড়িই ঊনবিংশ শতাব্দির (১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের নামফলক রয়েছে)। মূলত পানাম ছিলো হিন্দু ধনী ব্যবসায়ীদের বসতক্ষেত্র। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ছিলো ঢাকা-কলকাতা জুড়ে। তারাই গড়ে তোলেন এই নগর।
১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মোঘলদের সোনারগাঁ অধিকারের পর সড়ক ও সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানী শহরের সাথে পানাম এলাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। পানাম পুল (বিলুপ্ত), দুলালপুর পুল ও পানামনগর সেতুর অবস্থান ও তিনদিকের খাল-বেষ্টনী থেকে বোঝা যায় পানাম, সোনারগাঁর একটা উপশহর ছিলো। বাংলার স্বাধীন রাজা ঈসা খাঁর পদচারণা ছিলো এই নগরীতে। সুলতানী আমল থেকে এখানে বিকশিত ছিলো বাংলার সংস্কৃতি।
নির্মানকালঃ
প্রায় চারশত বছর আগ হতে পানাম নগরী স্থাপন শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ধাপে ধাপে মোগল নির্মাণ শৈলীর সাথে বৃটিশ স্থাপত্য শৈলীর সংমিশ্রনে প্রায় চারশত বছরের পর্যায় ক্রমিক স্থাপন পুন:স্থাপন প্রক্রিয়ায় পানাম নগরী বর্তমান রূপলাভ করে।
নির্মানশৈলীঃ
পানাম নগরীতে মোগল স্থাপত্য শৈলীর প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। তবে এতে পরবর্তিতে বৃটিশ বা কলোনিয়াল স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রন দেখাযায়। এটি ছকে আঁকা কোন নগরী নয় এবং এ নগরীর প্রতিটি বাড়ী সাইজ ও নকশায় ভিন্ন ভিন্ন। তাই এতে বাঙ্গালীর নিজ নিজ নির্মান কৌশলের ছাপ দেখা যায়। তাই এই নগরের নির্মানশৈলী একান্ত নিজস্ব ও বলা যায়। সঠিকভাবে একে পানাম স্থাপত্য কৌশল (Panam Style) বলা চলে। পানাম নগরীর নগর পরিকল্পনার মূল বৈশিষ্ট্য হলো এটি লেক বা খাল দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং সুরক্ষিত গেইট দ্বারা আবদ্ধ। সন্ধ্যার পূর্বেই গেইটসমূহ বন্ধ করে দেয়া হতো ফলে নগরীর অধিবাসীরা নিরাপদ জীবন যাপন করতো।
বিস্তারিতঃ
পানামের টিকে থাকা বাড়িগুলোর মধ্যে ৫২টি বাড়ি উল্লেখযোগ্য। পানাম সড়কের উত্তর পাশে ৩১টি আর দক্ষিণ পাশে ২১টি বাড়ি রয়েছে। বাড়িগুলোর অধিকাংশই আয়তাকার, উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত, উচ্চতা একতলা থেকে তিনতলা। বাড়িগুলোর স্থাপত্যে ঔপনিবেশিকতা ছাড়াও মোঘল, গ্রিক এবং গান্ধারা স্থাপত্যশৈলীর সাথে স্থানীয় কারিগরদের শিল্পকুশলতার অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়। প্রতিটি বাড়িই ব্যবহারোপযোগিতা, কারুকাজ, রঙের ব্যবহার, এবং নির্মাণকৌশলের দিক দিয়ে উদ্ভাবনী কুশলতায় ভরপুর। ইটের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই-লোহার তৈরি ব্র্যাকেট, ভেন্টিলেটর আর জানালার গ্রিল। মেঝেতে রয়েছে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই খিলান ও ছাদের মধ্যবর্তী স্থানে নীল ও সাদা ছাপ দেখা যায়। এছাড়া বাড়িগুলোতে নকশা ও কাস্ট আয়রনের কাজ নিখুঁত। কাস্ট আয়রনের এই কাজগুলো ইউরোপের কাজের সমতূল্য বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এর সাথে আছে সিরামিক টাইল্সের রূপায়ণ। প্রতিটি বাড়িই অন্দরবাটি এবং বহির্বাটি -এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। বেশিরভাগ বাড়ির চারদিকের ঘেরাটোপের ভিতর আছে উন্মুক্ত উঠান।
পানাম নগর পৃথীবির ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক শহরের একটি| অযত্ন অবহেলায় ক্রমশই জৌলুস হারাচ্ছে এই নগরীর বিভিন্ন স্থাপনা। ফিকে হয়ে যেতে বসেছে এর সৌন্দর্য্য। পর্যাপ্ত সংস্কার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা না নিলে আমাদের নতুন প্রজন্ম বঞ্চিত হবে বাংলার ইতিহাসের বিভিন তথ্য ও স্মৃতিচিহ্ন থেকে।
কিভাবে যাবেনঃ
গুলিস্থান থেকে মোগড়া পাড়া চৌরাস্তা পর্যন্ত বাস আছে। সার্ভিস অনুযায়ী জনপ্রতি ভাড়া ৩০ থেকে ৪৫ টাকা। স্পেশাল বাস গুলো ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে যায় তাই ভাড়া একটু বেশি হলে ও সময় কম লাগে । মোগড়া পাড়া থেকে সোনারগাঁও লোকশিল্প যাদুঘর পর্যন্ত অটোরিকশায় জনপ্রতি ভাড়া ১০ টাকা আর সরাসরি পানাম সিটি গেলে ১৫টাকা । সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প যাদুঘরে জনপ্রতি টিকেট ২০ টাকা এবং পানাম নগরীতে জনপ্রতি ১৫ টাকা টিকেট ।
ঘুরতে যাওয়ার আগে যে বিষয়ে লক্ষ্য রাখবেন –
আপনার ব্যক্তিগত ক্যামেরা/মোবাইল ফোন নিতে ভুলবেন না, কারণ সেখানে ছবি তোলার জন্য আলাদা করে তেমন ভালো কোন ব্যবস্থা নেই ।