পৈতৃক সূত্রে মাত্র দুই শতক জমিতে তার ঘর। করেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অফিস সহকারী কাম পরিচ্ছন্নতাকর্মীর চাকরি। অথচ তার জীবন-যাপন জমিদারদের মতো। সিরাজগঞ্জের জনতা ব্যাংক শাহজাদপুর শাখার অস্থায়ী অফিস সহকারী কাম পরিচ্ছন্ন কর্মী আওলাদ হোসেন আকন্দ রঞ্জুর ‘তেলেসমাতির’ এ জীবন দেখে বিস্মিত হতেন এলাকাবাসী। তবে ভয়ে কিছু বলতেন না তারা।
রোববার (৯ জুলাই) জনতা ব্যাংকের ওই শাখা থেকে কয়েক কোটি টাকা উধাও হওয়ার অভিযোগ করেন গ্রাহকরা। তারা ব্যাংকে টাকা তুলতে আসলে জানানো হয় অ্যাকাউন্টে টাকা নেই। তাদের অভিযোগ, জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলে পাঁচ কোটি টাকা লোপাট করেছেন। এ ঘটনায় রোববারই তদন্ত কমিটি গঠন করে জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। টাকা লোপাটের ঘটনা জানাজানির আগে থেকেই পলাতক রয়েছেন রঞ্জু।
এলাকাবাসী জানান, অফিস সহকারী হয়েও রঞ্জু এলাকায় ব্যাংক কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্রে তাকে ব্যাংক কর্মকর্তা হিসাবে উল্লেখ করা হতো। এ ছাড়া এলাকার তরুণ ও যুবকেরা তাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করত।
তারা বলেন, তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার নিজের গাড়িতে করে ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মাছ নিয়ে ঢাকা যেতেন। থাকতেন বিলাসবহুল হোটেলে। সেখানে ফুর্তি করতেন। রবিবারে বাড়ি ফিরে অফিস করতেন। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছিল তার অনুগত ও আজ্ঞাবহ। অনেক সিনিয়র অফিসাররাও তার চা-বিস্কুট ও নাশতা আনা-নেয়া করে ধন্য হতেন। ১০ লাখ টাকা ব্যয় করে হয়েছেন শাহজাদপুর উপজেলা জাতীয় শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পাড়কোলা ইসলামিয়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি। এ ছাড়া শাহজাদপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের পদ পেতে এক নেতাকে ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে রেখেছেন। পেয়েছেন পাড়কোলা খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদ।
তারা আরো বলেন, রঞ্জুর জীবন-যাপন ও চলাফেরা ছিল ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মতো। শার্ট লন্ড্রি করে বাড়িতে পৌঁছে দিলে বকশিশ দিতেন। নাপিতকে ৫০/১০০ টাকার স্থলে ৫০০/১০০০ টাকা দেওয়া ছিল তার সাধারণ ঘটনা।
সোমবার দুপুরে পাড়কোলা ও বাচামার গ্রামের একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ সব তথ্য জানিয়েছেন।
এলাকাবাসী আরো বলেন, এলাকার তরুণেরা তাকে ‘স্যার’ ডেকে হোটেলে খাওয়ার আবদার করলে তিনি ২-৫ হাজার টাকা দিয়ে দিতেন। ধর্মীয় জলসায় তিনি ৫-১০ হাজার টাকা দান করে সুনাম অর্জন করতেন। তার এই অঢেল খরচের টাকার উৎস কী তা কেউ বলতে পারেনি।
তার মা মনোয়ারা বেগমের দাবি, রঞ্জুর পৈতৃক সূত্রে দুই শতক জায়গায় একটি টিনের ঘর ছাড়া আর কিছু নেই।
অভিযোগকারী গ্রাহকদের দাবি, ব্যাংকের বড় কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত না থাকলে রঞ্জুর মতো একজন পিয়নের পক্ষে একা জালিয়াতি করে এত টাকা আত্মসাৎ সম্ভব না।
রোববার আওলাদ হোসেন আকন্দ রঞ্জুর মা আনোয়ারা বেগম ও ভাতিজি জান্নাতি খাতুন বলেন, এ ঘটনায় রঞ্জুকে ফাঁসানো হয়েছে। বিষয়টি এ ব্যাংকের ম্যানেজারসহ সবাই জানে। বৃহস্পতিবার অফিস সহকারী কাম পরিচ্ছন্নতাকর্মী আওলাদ হোসেন আকন্দ রঞ্জু অফিসে গেলে জনতা ব্যাংক শাহজাদপুর শাখার ম্যানেজার জেহাদুল ইসলাম তাকে ১৫ দিনের ছুটি দিয়ে কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসতে বলে। সেই থেকে তিনি উধাও রয়েছেন। কোথায় গেছে তা আমাদের জানা নেই।
তারা বলেন, রঞ্জু ওই ব্যাংকের অফিস সহকারী হলেও সে ২০ বছর ধরে কোট-প্যান্ট-টাই পরে বড় সাহেবের মতো চেয়ার-টেবিলে বসে অফিস করত। সে যে টেবিলে বসতো ব্যাংক কর্তৃপক্ষ রহস্যজনকভাবে সেই টেবিল-চেয়ার ওই স্থান থেকে সরিয়ে ফেলেছে।
এ বিষয়ে রঞ্জুর শ্যালক ইসরাফিল শেখ বলেন, এই টাকা আত্মসাতের জন্য তার ভগ্নিপতি একা দায়ী নন। এ ব্যাংকের অনেকেই জড়িত। রঞ্জু এক মাস আগে প্রাইভেট কার নিয়ে ঢাকায় তার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ৩৫ লাখ টাকা দিয়ে এসেছে। সে মাঝে মাঝে ওই কর্তার বাসায় বড় বড় মাছ ও কাপড়-চোপড় নিয়ে দিয়ে আসে। নিজেকে এক এমডির আত্মীয় পরিচয় দিত। ওই এমডির ভয়ে ব্যাংকের কেউ তাকে কিছু বলতে সাহস পেত না। তবে ওই এমডির নাম জানা নেই।
তবে সোমবার একটি সূত্র জানিয়েছে, অফিস সহকারী রঞ্জু পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। সে যেকোনো মুহূর্তে আটক হতে পারে।
গ্রাহকদের ‘৫ কোটি টাকা’ উধাও হওয়ার বিষয়ে জনতা ব্যাংক সিরাজগঞ্জ জেলা অফিসের ডিজিএম জাহিদুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, টাকার পরিমাণ এত বেশি হবে না। এটা ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা হবে। আর গ্রাহকসংখ্যা ১০/১২ জনের বেশি নয়।
তিনি বলেন, আমরা এখনো ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করছি। এটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সঠিক সংখ্যা বলা সম্ভব না।
অপরদিকে ক্ষতিগ্রস্ত বাচামারা গ্রামের গ্রাহক মনোয়ারা বেগম, হানিফ খান ও বাড়াবিল গ্রামের রত্না খাতুন বলেন, সোমবার সকালে ব্যাংকে উপস্থিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ১৬ জনের একটি তালিকা করেছি। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে এ ১৬ জনের প্রায় ৫০ লাখ টাকা উধাও হয়ে গেছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ রঞ্জুর মাধ্যমে কৌশলে সহজ-সরল, অশিক্ষিত এসব নারী গ্রাহককে ধোঁকা দিয়ে এ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আমরা রঞ্জুসহ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নামে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এ বিষয়ে শাহজাদপুর থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) সাজ্জাদুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। মামলা হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা গেছে, জনতা ব্যাংকের ওই শাখায় রবিবার সকালে ১৫-১৬ জন গ্রাহক তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করতে যান। এ সময় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নেই বলে জানায়। ফলে ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে তাদের বাগ্বিতণ্ডা হয়। এ খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লে কয়েক শ গ্রাহক ভিড় জমায় ও খোয়া যাওয়া টাকা ফেরতের দাবি জানিয়ে ব্যাংক ঘেরাও করে।
এ সময় উত্তেজিত গ্রাহকরা জানান, গত ১২-১৩ বছরে এ ব্যাংকের শতাধিক গ্রাহকের প্রায় পাঁচ কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে। এখন তারা টাকা উত্তোলন করতে এসে জানতে পারেন জমাকৃত টাকা নেই।
এ ঘটনার পর থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আত্মগোপনে আছেন আওলাদ হোসেন আকন্দ রঞ্জু। ফলে এ ঘটনার জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ রঞ্জুকে এককভাবে দায়ী করছে।