আবুল কালাম আজাদঃ-চীনা অর্থায়নে ঢাকার জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত বিদ্যমান রেলপথের সমান্তরালে নতুন একটি ডুয়াল গেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল। এজন্য একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগও দিয়েছিল সরকার। যদিও পরে চীন অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোয় প্রকল্পটি আর বাস্তবায়ন করা যায়নি। বর্তমানে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্পটিতে অর্থায়নে সম্মতি রয়েছে জাইকারও। আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর চলাকালে প্রকল্পটিতে জাপানি বিনিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে বলে প্রত্যাশা করছেন রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা।
২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় প্রকল্পটি নিয়ে ঢাকা-বেইজিং সমঝোতা সই হয়। জিটুজি ভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটিতে চীনের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেও নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রকল্প ব্যয় কমানোর নির্দেশনা দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর প্রকল্পের অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় চীন। এ প্রকল্পে এখন অর্থায়নকারী হিসেবে জাইকাকে চাইছেন রেল খাতের নীতিনির্ধারকরা।
প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে বিনিয়োগ আলোচনার জন্য নয়টি প্রকল্পের একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। তালিকার প্রথমে রাখা হয়েছে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়াল গেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পকে। প্রকল্পের মাধ্যমে ১৬২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেল রুটে সব মিলিয়ে মোট ১৯৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী, এটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৪ কোটি ৬৩ লাখ ডলার।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, জাইকা এরই মধ্যে প্রকল্পটিতে অর্থায়নের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রস্তুতিমূলক জরিপ করার জন্য সংস্থাটির পরামর্শকরা কাজ শুরু করেছেন। চলতি মাসেই তাদের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে। এর আগে গত ৪-১৫ সেপ্টেম্বর জাইকার একটি ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন’ বাংলাদেশ সফর করে। মিশনের সদস্যরা বাংলাদেশ রেলওয়ে ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আলোচনার কার্যপত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও জাইকার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষর করা হয়েছে। রেলপথটির বিস্তারিত নকশা প্রণয়নকাজের জন্য পরামর্শকদের সঙ্গে আগামী বছরের মার্চে চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে।
বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়েতে জাপানি অর্থায়নে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণ সহায়তার পরিমাণ ১৪৩ কোটি ডলার। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত সেতুর নির্মাণকাজের অগ্রগতি হয়েছে ৪৫ শতাংশ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন জাপান সফরে আলোচনার জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয় যেসব প্রকল্পের সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনকে (কমলাপুর) মাল্টিমোডাল হাবে রূপান্তর। এটি বাস্তবায়ন হলে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে নির্মাণাধীন ও নির্মিতব্য চারটি মেট্রোরেলের সংযোগ তৈরি হবে। সংযোগ থাকবে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ প্রয়োজনীয় সড়ক অবকাঠামোরও। যাতায়াতের এসব মাধ্যমকে সমন্বয় করে স্টেশনটিকে গড়ে তোলা হবে মাল্টিমোডাল হাবে। প্রকল্পটির জন্য এরই মধ্যে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে একটি ‘মেমোরেন্ডাম অব কো-অপারেশন’ বা এমওসি স্বাক্ষরিত হয়েছে। জিটুজি ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এমওসি অনুযায়ী জাপানের ভূমি, পরিবহন, অবকাঠামো ও পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রকল্পটির জন্য কাজিমা করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি অংশীদার হিসেবে মনোনীত করেছে। প্রকল্পটির ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৪০ কোটি ডলার।
পদ্মা নদীতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সমান্তরালে নতুন একটি রেলসেতু নির্মাণ প্রকল্পও রাখা হয়েছে সারসংক্ষেপে। প্রস্তাবিত ২ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলসেতুটি তৈরিতে খরচ হতে পারে ৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। সেতুটি নির্মাণের জন্য কানাডার দুটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেছে রেলওয়ে। অন্যদিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় হালনাগাদ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, বিশদ নকশা প্রণয়নের জন্য একটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
তিস্তা নদীতে বিদ্যমান রেলসেতুর সমান্তরালে নতুন রেলসেতু নির্মাণ প্রকল্প রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা সারসংক্ষেপের চার নম্বরে প্রকল্পে। ৭০০ মিটার দীর্ঘ এ সেতু তৈরিতে খরচ হতে পারে ৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সারসংক্ষেপের ৫ নম্বরে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদীতে শম্ভুগঞ্জ সেতু নির্মাণ প্রকল্প। মূল সেতু ও ভায়াডাক্ট মিলে অবকাঠামোটির দৈর্ঘ্য হবে ২ কিলোমিটার। সেতুটি তৈরি করতে খরচ হবে ১৬ কোটি ডলার।
মহেশখালী থেকে মাতারবাড়ীতে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত ডুয়াল গেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পকে আলোচনার সারসংক্ষেপে রাখা হয়েছে। প্রকল্পের জন্য এরই মধ্যে এডিবির অর্থায়নে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ নকশার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এতে খরচ হবে ৩৬ কোটি ৬৩ লাখ ডলার।
প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা সারসংক্ষেপে স্থান পাওয়া অন্য প্রকল্পগুলো হলো চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় রেলওয়ে ভবন (সিআরবি) উন্নয়ন, রেলওয়ের মাস্টারপ্ল্যান হালনাগাদ এবং ঢাকা শহরের জন্য ‘সাব-আরবান’ রেল ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রকল্প।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয় থেকে জাপানি বিনিয়োগের জন্য প্রকল্পের সারসংক্ষেপগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে একাধিক প্রকল্পে অর্থায়ন করতে জাইকা সম্মতি দিয়েছে। এসব প্রকল্পের প্রাক-প্রস্তুতির কাজও শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে একাধিক প্রকল্পে জাপানি বিনিয়োগের বিষয়ে অগ্রগতি হওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তবে যেসব প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের আলোচ্যসূচিতে রাখার জন্য সেগুলো চূড়ান্ত করবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, জাপানি বিনিয়োগের জন্য রেলের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত কিছু আমি এখন পর্যন্ত জানি না। তবে বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। আর প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া আমাদের একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা সব প্রক্রিয়া মেনেই রেলের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি