র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, র্যাব এলিট ফোর্স হিসেবে আত্মপ্রকাশের সূচনালগ্ন থেকেই বিভিন্ন ধরণের অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল ও মাদকবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি খুন, চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই চক্রের সাথে জড়িত বিভিন্ন সংঘবদ্ধ ও সক্রিয় সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের গ্রেফতার করে সাধারণ জনগণের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে র্যাবের জোড়ালো তৎপরতা অব্যাহত আছে। পাশাপাশি বিভিন্ন হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত দীর্ঘদিনের পলাতক আসামী গ্রেফতার করে দেশব্যাপী সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর ভোর ০৩.০০ ঘটিকায় বনানীর ট্রাম্পস্ ক্লাবের নীচে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। উক্ত ঘটনায় ভিকটিমের বড় ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী বাদী হয়ে গুলশান থানায় বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নম্বর ৫৯ তারিখঃ ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯৮। ধারা ৩০২/৩৪/৩২৩/৩২৬/৩০৭। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ০৯ জনের বিরুদ্ধে ডিবি পুলিশ বিজ্ঞ আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। ২০০১ সালে ৩০ নভেম্বর উক্ত মামলায় অভিযোগপত্র গঠন করা হয়। পরবর্তীতে উক্ত মামলা বিচারের জন্য দ্রæত বিচার ট্রাইবুনালে প্রেরণ করা হয়। মামলা দ্রæত বিচার ট্রাইবুনালে প্রেরণের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ঐ মামলার ০১ নং আসামী আদনান সিদ্দিকী দুই বছর পর হাইকোর্টে রীট করেন। এর প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০০৪ সালের ১৭ ফেব্রæয়ারি মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুলসহ আদেশ দেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞ হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১৫ সালের ০৫ আগস্ট পুনরায় আরেকটি রায় দেন। এই রায়ে পূর্বের জারীকৃত রুলটি খারিজ করে দেওয়া হয়। প্রত্যাহার করা হয় হাইকোর্ট এর স্থগিতাদেশ। পরবর্তীতে বিজ্ঞ আদালত ২৮ মার্চ ২০২২ অনুপস্থিতির কারণে তাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। ফলশ্রæতিতে র্যাব বর্ণিত ঘটনায় পলাতক আসামীদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১০ এর অভিযানে রাজধানীর গুলশান হতে উক্ত মামলার চার্জশীটভূক্ত পলাতক আসামী আশিষ রায় চৌধুরী@ বোতল চৌধুরী (৬৩), পিতাঃ কমল ভুষণ রায় চৌধুরী, তেজগাঁও, ঢাকা’কে গ্রেফতার করে। উদ্ধার করা হয় ২২ বোতল বিদেশি মদ, ১৪ বোতল সোডা ওয়াটার, ১ টি আইপ্যাড, ১৬টি বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড, ২টি আইফোন ও নগদ ০২ লক্ষ টাকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবদে গ্রেফতারকৃত বর্ণিত হত্যাকান্ডের সাথে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায় যে, ১৯৯৬ সালে বনানীর আবেদীন টাওয়ারে গ্রেফতারকৃত আশিষ রায় চৌধুরী এবং আসাদুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম এর যৌথ মালিকানায় ট্রাম্পস্ ক্লাব যখন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে ৫০ লক্ষ টাকার পুঁজির নিয়ে ট্রাম্পস্ ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ৫০ লক্ষ টাকার মধ্যে ২৫ লক্ষ টাকা লগ্নি করেছিল আশিষ রায় এবং অবশিষ্ট ২৫ লক্ষ টাকা লগ্নি করেছিল পলাতক বান্টি ইসলাম।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই ক্লাবে বিভিন্ন বয়সী মানুষ সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ভোর রাত পর্যন্ত নানাবিধ অসামাজিক কার্যকলাপের জন্য আসত। গ্রেফতারকৃত আশিষ রায় চৌধুরী ১৯৯৬ সাল থেকেই বর্ণিত ক্লাবে বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ করে আসছিল। পর্যায়ক্রমে এই ট্রাম্পস্ ক্লাবটি সকল আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন এবং গ্যাং লিডারদের একটি বিশেষ আখড়ায় পরিণত হয় এবং এখানে সবচেয়ে বেশি যাতায়াত ছিল আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের। আজিজ মোহাম্মাদ ভাই মূলত ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের চক্রগুলোর সাথে বিভিন্ন ধরণের মিটিং বা তাদের পরিচালনা করার জন্য সেই ক্লাবে নিয়মিত যাতায়াত করত এবং সেই ক্লাবকে ব্যবহার করত। সেই সুবাদে ট্রাম্পস্ ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলাম এবং আশিষ রায় চৌধুরীর সাথে তার সখ্যতা তৈরি হয়।
আজিজ মোহাম্মদ ভাই এর ভাতিজিকে বান্টি ইসলাম বিয়ে করার সুবাদে তাদের মধ্যে একটি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল এবং বান্টি ইসলাম ও আশিষ রায় তারা যুবক বয়স থেকে একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পরবর্তীতে তাদের এই বন্ধুত্ব ব্যবসায়ীক অংশিদারিত্বে রূপ নেয় এবং একসাথে পার্টনারশীপে ট্রাম্পস্ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে পরিচালনা করা শুরু করে। আজিজ মোহাম্মদ ভাই, বান্টি ইসলাম ও আশিষ রায় চৌধুরী একসাথে ট্রাম্পস্ ক্লাবে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড ও অপরাধ জগতের ব্যক্তিদের সাথে জড়িত থেকে তারা এই ধরণের অপরাধ কার্যক্রম পরিচালনা করত।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আরও জানায় যে, বনানীর আবেদীন টাওয়ারের অষ্টম তলায় অবস্থিত ট্রাম্পস্ ক্লাবের ঠিক পাশেই ছিল ঐ সময়কার বনানীর সবচেয়ে বড় মসজিদ বা বনানীর জামে মসজিদ। যেহেতু এই ট্রাম্পস্ ক্লাবে সন্ধ্যা থেকে শুরু করে সারারাতব্যাপী বিভিন্ন ধরণের অসামাজিক কর্মকান্ড পরিচালিত হত। ভিকটিম চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী বনানী মসজিদের মসজিদ কমিটি নিয়ে বারংবার ট্রাম্পস্ ক্লাবের এই ধরণের অশ্লীলতা বন্ধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কিন্তু ভিকটিম সোহেল চৌধুরী যে মসজিদ কমিটি নিয়ে এই ট্রাম্পস্ ক্লাবের অশ্লীলতা ও অসামাজিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল এই কারণে ট্রাম্পস্ ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলাম এবং আশিষ রায় চৌধুরীর ব্যবসায়িক স্বার্থে মারাত্মকভাবে আঘাত হানে। অপরদিকে আজিজ মোহাম্মদ ভাই যেহেতু আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেক্টিভিটি মেইনটেইন করার জন্য ঢাকায় ট্রাম্পস্ ক্লাবকে একটা সেইফ হাউজ হিসেবে বেছে নিয়েছিল তার সেই স্বার্থেও আঘাত লাগে। আবার ইমনের মতো শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও যেহেতু অসামাজিক কার্যকলাপ করতে একমাত্র সেইফ হাউজ পেয়েছিল, ঐ সময়ে যদি ক্লাবটি বন্ধ হয়ে যেত তাহলে তারা সকলেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ত। সকল ধরণের অসামাজিক কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এই ট্রাম্পস্্ ক্লাব। চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ঐ সময় সমাজের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মসজিদ কমিটির পক্ষ হয়ে এই ট্রাম্পস্ ক্লাবটি বন্ধ করতে বার বার চেষ্টা করায় এই সকল গ্রæপের অর্থাৎ ব্যবসায়িক বান্টি ইসলাম ও আশিষ রায় চৌধুরী, আজিজ মোহাম্মদ ভাই এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন এর চক্ষুশূলে পরিণত হয়। বর্ণিত ঘটনায় গত ২৪ জুলাই ১৯৯৮ তারিখে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সাথে ভিকটিমের সরাসরি তর্ক এবং এক পর্যায়ে সাথে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে আজিজ মোহাম্মদ ভাই সোহেল চৌধুরীর উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে তার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বান্টি ইসলাম ও আশিষ রায় চৌধুরীকে অনুরোধ জানায়।
ট্রাম্পস্ ক্লাবে জনসম্মুখে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে সোহেল চৌধুরী অপমান করার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বান্টি ইসলাম ও আশিষ রায় চৌধুরী একটি পরিকল্পনা করতে থাকে। ট্রাম্পস্ ক্লাবে তৎকালীন শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তখন বান্টি ইসলাম, আশিষ রায় চৌধুরী ও আজিজ মোহাম্মদ ভাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম@ ইমনকে দিয়ে সোহেল চৌধুরীকে হত্যার প্রস্তাব দেয়। তৎকালীন মাফিয়া আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও ট্রাম্পস্ ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলাম ও আশিষ রায় চৌধুরীর অনুরোধে ইমন তাদের সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করতে সোহেল চৌধুরীকে হত্যার প্রস্তাবে রাজী হয় এবং পরবর্তীতে ইমন এই হত্যাকান্ডটি সম্পন্ন করে।
সর্বশেষ ২৮ মার্চ ২০২২ তারিখে আশিষ রায় চৌধুরীর নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হলে সে আগামী ০৭ এপ্রিল ২০২২ তারিখ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে কানাডায় চলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল বলে গ্রেফতারকৃত জানায়। পরবর্তীতে তাকে রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।