রাজধানীর শাহজাহানপুরে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যার ঘটনায় অন্যতম সন্দেহভাজন সুমন সিকদার ওরফে মুসাকে ওমান থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
তাকে বহনকারী উড়োজাহাজটি বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অতিরিক্ত আইজিপি এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘মুসা ডিবির আসামি। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হবে।’
এর আগে বুধবার গভীর রাতে মুসাকে নিয়ে ওমান থেকে রওনা হন বাংলাদেশ পুলিশের তিন কর্মকর্তা।
ওমানে মুসা আটক হওয়ার পর দুই দেশের কূটনৈতিক সমঝোতায় তাকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মুসাকে আনতে ওমানে যান ডিবির মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহিদুর রহমান, অতিরিক্ত উপকমিশনার রফিকুল ইসলাম ও পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফয়েজ উদ্দীন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মুসা প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই পালিয়ে যান। সেখান থেকে যান ওমানে। ইন্টারপোলের দেয়া তথ্যে গত ১৭ মে মুসাকে আটক করে ওমান পুলিশ। এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ডিবি ও এনসিবির তৎপরতায় মুসাকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়।
গত ২৪ মার্চ রাত ১০টার দিকে শাহজাহানপুরের আমতলা এলাকায় অস্ত্রধারীর গুলিতে নিহত হন গাড়িতে থাকা মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক টিপু।
এলোপাতাড়ি গুলিতে আহত হন গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা ২৪ বছর বয়সী কলেজছাত্রী প্রীতি।
এ ঘটনার পরের দিন টিপুর স্ত্রী ফারজানা ইসলাম ডলি মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়।
মামলার পর ২৬ মার্চ রাতে বগুড়া থেকে শ্যুটার মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। ২৮ মার্চ তাকে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেয় আদালত।
টিপু হত্যার ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তারের পর গত ২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব। এতে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, দীর্ঘদিন ধরে টিপু ও তার হত্যার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে বিরোধ চলছিল। মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, স্কুল-কলেজের ভর্তি বাণিজ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনেক পুরোনো বিষয়।
তিনি জানান, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরম্পরায় ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে মিল্কী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। মিল্কী হত্যার তিন বছরের মধ্যে একই এলাকার বাসিন্দা রিজভী হাসান ওরফে বোচা বাবু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, বোচা বাবু হত্যা মামলায় ওমর ফারুক, নাসির ও সালেহ চার্জশিটভুক্ত আসামি আর কাইল্লা পলাশ মামলাটির একজন সাক্ষী। এই মামলার বিচারকাজ প্রভাবিত করতে একই মামলার আরেক আসামি মুসার সঙ্গে ওমর ফারুক, নাসির, সালেহ ও কাইল্লা পলাশ যুক্ত হয়ে টিপু হত্যার পরিকল্পনা করেন।
তিনি জানান, মিল্কী হত্যাকাণ্ডের পর এই হত্যায় টিপুর সম্পৃক্ততা প্রমাণে নানাভাবে চেষ্টা করে আসছিল ওমর ফারুক, পলাশসহ একটি পক্ষ। এরপরও জাহিদুল ইসলাম টিপু মামলা থেকে অব্যাহতি পান। পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার ওমর ফারুক ও অন্য সহযোগীরা স্বার্থগত দ্বন্দ্বের কারণে টিপুর অন্যতম সহযোগী রিজভী হাসান ওরফে বোচা বাবুকে ২০১৬ সালে হত্যা করেন।
র্যাব জানিয়েছে, বোচা বাবু হত্যা মামলার মূল আসামিরা টিপুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে মামলাটিকে প্রভাবিত ও বাদীকে ভয় দেখানো যাবে বলে মনে করেন। সে অনুযায়ী বোচা বাবু হত্যা মামলার আসামি ওমর ফারুক টিপু হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করার জন্য সন্ত্রাসী ও শুটার মুসাকে দায়িত্ব দেন ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক। মুসা ও তার ভাই সালেহও বাবু হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মোট ১৫ লাখ টাকার চুক্তি হয়। এতে ৯ লাখ টাকার জোগান দেন ওমর ফারুক। বাকি ৬ লাখ টাকা দেন মুসা, সালেহ ও নাসির। গ্রেপ্তার মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশ হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য ফারুক ও মুসাকে ফোনে কয়েকজন সন্ত্রাসীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত সমন্বয়ের জন্য মুসা গত ১২ মার্চ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে যান। দুবাইয়ে যাওয়ার সময় মুসা ৫ লাখ টাকা নিয়ে যান এবং হুন্ডির মাধ্যমে মুসাকে আরও ৪ লাখ টাকা পাঠানো হয়। বাকি ৬ লাখ টাকা দেশে হস্তান্তর করার চুক্তি হয়।
দুবাই পৌঁছে মুসা শুটার ভাড়া করাসহ ব্যাকআপ টিম দিয়ে হত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা সাজান। হত্যাকাণ্ডটি দেশে সংগঠিত হলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করা হয় দুবাই থেকে। আর নজরদারির কাজ দেয়া হয় ওমর ফারুক, নাসির ও পলাশকে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশ থেকে নাসির উদ্দিন ওরফে কিলার নাসির, মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশসহ আরও কয়েকজন জাহিদুল ইসলাম টিপুর অবস্থান সম্পর্কে বেশ কয়েক দিন ধরে মুসার কাছে তথ্য পাঠাতেন।
ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর নাছির চারবার জাহিদুল ইসলাম টিপুর অবস্থান সম্পর্কে মুসাকে জানান। পরবর্তী সময়ে টিপু গ্র্যান্ড সুলতান রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় কাইল্লা পলাশ তাকে নজরদারিতে রাখেন এবং তার অবস্থান সম্পর্কে আন্ডারওয়ার্ল্ড সন্ত্রাসী ফ্রিডম মানিককে জানান। এরপর আনুমানিক রাত সাড়ে ১০ টার দিকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে কন্ট্রাক্ট পাওয়া কিলার টিপুকে হত্যা করে।