বিদেশে পাচার হওয়া কোটি কোটি টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে কমপক্ষে ১০টি দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে চেয়েছে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন ঠেকাতে গঠিত সরকারের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে হাইকোর্টের শাখায় প্রতিবেদনও দাখিল করেছে বিএফআইইউ)।
মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চে বিএফআইইউ কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদনটি দাখিল করেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।
বিএফআইইউ’র প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস সই করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য কয়েকটি দেশের সাথে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তি (এমএলএ) সইয়ের যৌক্তিকতা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে অবহিত করেছে বিএফআইইউ। দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও হংকং-চায়না।
আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিদেশে অর্থপাচারে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা ও পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার জন্য প্রস্তাবিত ‘রিসার্স সেলে’ লোকবল পদায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ওই সেলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উপযুক্ত লোকবল পদায়নের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
অর্থ ফেরত আনার কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাচার করা অর্থ ফেরত আনা সম্পর্কিত মামলায় তথ্য-প্রমাণ বিদেশি রাষ্ট্র থেকে যথাসময়ে না পাওয়ার প্রেক্ষাপটে অ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনার বিষয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের গত ৩ জানুয়ারি ষষ্ঠ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য ৬/৭টি দেশের সাথে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তি (এমএলএ চুক্তি) সইয়ের বিষয়টি পর্যালোচনার লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিএফআইইউ ও বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অংশগ্রহণে সভা আয়োজন করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
‘ওই সিদ্ধান্ত মতে—বিএফআইইউ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ অর্থ মন্ত্রণালয়কে সভা আয়োজনের অনুরোধ করে। পরবর্তী সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কোন কোন দেশের সাথে এ পর্যায়ে এমএলএ চুক্তি সই করতে হবে এবং এর যৌক্তিকতা জানানোর জন্য বিএফআইইউকে অনুরোধ করলে বিএফআইইউ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং-চায়নার সাথে এমএলএ চুক্তি সইয়ের যৌক্তিকতা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে অবহিত করে।
ভারতীয় রায় সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, হাইকোর্টের পরামর্শ মোতাবেক ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ‘রামজিৎ মালানি বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড আদার্স’ শীর্ষক মামলার রায় সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করা হয়েছে।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর বিষয়ে নিজেদের কৌশল সম্পর্কে বিএফআইইউ প্রতিবেদনে জানানো হয়, ভারতের নেওয়া ব্যবস্থার অনুরূপ ব্যবস্থা বাংলাদেশেও আইনানুগভাবে গ্রহণ করা যায় কিনা তা পর্যালোচনার সুপারিশ সুইস ব্যাংকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে প্রস্তুতকৃত কৌশলপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সুইস ব্যাংকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে প্রস্তুতকৃত কৌশলপত্র/প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির ৩০ আগস্ট অনুষ্ঠিত ২৬তম সভার আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটি জাতীয় সমন্বয় কমিটির পরবর্তী সভায় আলোচনা ও অনুমোদন পাবে আশা করছে বিএফআইউ।
এর আগে গত ১০ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ডিকাব) আয়োজিত ‘ডিকাব টক’ অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি শুয়ার্ড বলেছিলেন, সুইস ব্যাংকে জমা রাখা অর্থের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার সুনির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তির জন্য তথ্য চায়নি। সুইস ব্যাংকের ত্রুটি সংশোধনে সুইজারল্যান্ড কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তবে আমি আপনাদের জানাতে চাই, সুইজারল্যান্ড কালো টাকা রাখার কোনও নিরাপদ ক্ষেত্র নয়।
পরে গত ১১ আগস্ট বিষয়টি নজরে নিয়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমাকারীদের তথ্য কেন জানতে চাওয়া হয়নি তা রাষ্ট্রপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) জানাতে বলেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই আদেশ দেন।
এদিকে গত ১২ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, সুইস রাষ্ট্রদূত মিথ্যা বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ফিন্যান্স সেক্রেটারি আমাকে আগে জানিয়েছিলেন, তারা তথ্য চেয়েছিলেন, তারা (সুইস ব্যাংক) উত্তর দেননি।
এরপর গত ১৪ আগস্ট সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি ব্যক্তিদের অর্থ রাখার বিষয়ে তথ্য জানাতে সর্বমোট তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল বলে হাইকোর্টকে জানায় বিএফআইইউ।
তখন সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি ব্যক্তিদের অর্থ রাখা নিয়ে তথ্য জানানোর বিষয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ডের বক্তব্য প্রত্যাহার করা ছাড়া কোনও উপায় নেই বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।
আদালত আরও বলেন, রাষ্ট্রদূত কীভাবে বললেন বাংলাদেশিদের অর্থ জমার বিষয়ে কোনও তথ্য চাওয়া হয়নি, তা আমাদের বোধগম্য নয়। সুইস রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য রাষ্ট্রকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। আপনারা (রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের আইনজীবী) যে তথ্য উপস্থাপন করেছেন তাতে প্রমাণিত রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য সাংঘর্ষিক।
বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনের ওপর শুনানিকালে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এসব মন্তব্য করেন।
এদিকে সুইস ব্যাংক সংক্রান্ত তথ্য আদালতে দাখিল করার বিষয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাসকে গত ৩০ আগস্ট তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। এর ধারাবাহিকতায় তিনি সশরীরে হাজির হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পরে গত ৩১ আগস্ট পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের বিষয়ে চিঠি চালাচালির বাইরে আর কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে বিএফআইইউ—তা আগামী ২৬ অক্টোবরের মধ্যে জানানোর নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, আগের আদেশের ধারাবাহিকতায় বিএফআইইউ হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। প্রতিবেদনটি হলফনামা আকারে প্রস্তুত করা হয়েছে। আগামীকাল বুধবার (২৬ অক্টোবর) প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চে দাখিল করা হবে।