প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-২ হাফিজুর রহমান লিকুর ছদ্মবেশ ধারণ ও মিথ্যা পরিচয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি ও বদলি এবং নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন প্রকল্প পাইয়ে দেয়ার মিথ্যা আশ্বাসে প্রতারণা করতেন তারা। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগে ওই প্রতারক চক্রের দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মজিবুর রহমান খন্দকার (৭৩) ও তার ছেলে জাহিদুর রহমান খন্দকার (৪১)।
শনিবার রাতে উত্তরা পশ্চিম থানাধীন ১৮ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর সেক্টরের ৩৭ নম্বর বাড়ির সামনে থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ। তাদের কাছ থেকে পুরোনো ৪টি মোবাইল ফোন, ৪টি সিম কার্ড, প্রতারণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ভুয়া পরিচয়পত্র, মাদক গ্রহণে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম ও বেশ কিছু ভুয়া নিয়োগপত্র।
ডিবি পুলিশ জানায়, রোববার রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার এক ভুক্তভোগীকে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভলপমেন্ট বোর্ডে (বিপিডিবি) চাকরি দেয়ার কথা বলে ৬ লাখ টাকা লেনদেন করার ছিল গ্রেপ্তারকৃতদের। তার আগেই প্রতারকদের গ্রেপ্তার করা হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-২ হাফিজুর রহমান লিকুর ছদ্মবেশ ধারণ ও মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি, বদলি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন প্রকল্প পাইয়ে দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে আসছে। এমন তথ্য পেয়ে সত্যতা নিশ্চিতে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অভিযুক্তদের অবস্থান শনাক্ত করে গতরাতে উত্তরা পশ্চিম থানা দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা সম্পর্কে বাবা ও ছেলে। প্রতারণায় ছেলে জাহিদুর রহমান প্রধান অভিযুক্ত।
ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের এডিসি সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, গ্রেপ্তার জাহিদুর রহমান খন্দকার ইংরেজি মাধ্যমে মানারত ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ও-লেভেল পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। একসময় পড়া-লেখা বাদ দিয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। তারপর থেকে বিভিন্ন রকম প্রতারণায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতা পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে থাকেন। তার বাবা মজিবুর রহমান বিভিন্ন ছদ্মনামে প্রতারণা করে থাকেন। তিনি নিজেকে বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনীর রিটায়ার্ড মেজর বলে পরিচয় দেন। তাছাড়াও তিনি ব্যবসায়ী, হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার, পিএইচডি ডিগ্রিধারী বলে পরিচয় দিতেন।
তিনি বলেন, দুই মাস আগে থেকে জাহিদুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-২ হাফিজুর রহমান লিকুর ছদ্মবেশ ধারণ করে খোদ নিজের বাবার সঙ্গে প্রতারণা করেন। বাবাকে বিশ্বাস করান প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-২ লিকুর সঙ্গে তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেও বাবাকে প্রলুব্ধ করেন। এরপর অন্য মোবাইল নাম্বার থেকে ছেলে জাহিদুর নিজেকে এপিএস-২ এর পরিচয় দিয়ে বাবার সঙ্গেও কথা বলেন। বিভিন্ন কাজে সাহায্য করার আশ্বাস দেন। এতে মজিবুর রহমান প্রলুব্ধ হন। বিভিন্ন ব্যক্তিকে এপিএস-২ এর তদবিরের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে চাকরিতে নিয়োগ, বদলির আশ্বাস, পদোন্নতি লোভ দেখিয়ে প্রতারণা শুরু করেন এবং তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন এবং আত্মসাৎ করেন।
ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম-দক্ষিণ বিভাগ জানিয়েছে, ইতোমধ্যে প্রতারণার জন্য মজিবুর রহমান অনেকগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানের ফাইল তৈরি করেছেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অতিরিক্ত সচিব থেকে সচিব পদে পদোন্নতি, অতিরিক্ত মহাপরিচালক থেকে মহাপরিচালক পদে পদোন্নতি (বাংলাদেশ রেলওয়ে), সিনিয়র সহকারী পরিচালক থেকে উপ-পরিচালক পদে পদোন্নতি (পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন, পুলিশ ইন্সপেক্টর থানায় ওসি হিসেবে পদায়ন, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডে নিয়োগ।
প্রধান অভিযুক্ত জাহিদুর রহমান খন্দকার প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-২ হাফিজুর রহমান লিকুর ছদ্মবেশ ধারণ ছাড়াও জাতীয় শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, হযরত শাহাজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের বি.এম. ট্রান্সপোর্ট লি. এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি হিসেবে পরিচয় দিতেন। আরও তৈরি করেছেন অস্ট্রেলিয়ার ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স, ভুয়া এনআইডি।
ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) এর ফাইনান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের এডিসি মাহমুদুল হাসান বলেন, ছেলের কথায় বাবা প্রতারণায় জড়ালেও ছেলেই যে লিকু সেজে প্রতারিত করছে তা তিনি গ্রেপ্তারের আগে পর্যন্ত জানতে পারেননি। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-২ এর সহযোগিতায় চাকরি হবে।
তিনি বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত ৬/৭ জনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য পেয়েছি। আজও একজনকে বিপিডিবিতে চাকরি দেয়ার কথা বলে ৬/৭ লাখ টাকা লেনদেনের কথা ছিল।
অবৈধভাবে চাকরি প্রত্যাশা করে কারো সঙ্গে লেনদেন মানেই প্রতারণা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, অবৈধভাবে চাকরি পাওয়ার জন্য টাকা পয়সা লেনদেন উচিত নয়। অপরিচিত কেউ সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে চাকরি দিতে চাইলে বুঝতে হবে পাতানো ফাঁদ, তাতে পা দেয়া যাবে না। কোনো ধনেরে হয়রানির শিকার হলে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশি সহায়তা নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।