সদ্য সমাপ্ত ২০২৩ সালে দেশের বাজারে প্রথমবারের মতো স্বর্ণের দাম ভরিপ্রতি লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। বছরজুড়ে দফায় দফায় দাম বাড়ায় বছর শেষে স্বর্ণের দাম এখন দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত দেশের বাজারে ২৯ বার স্বর্ণের দাম সমন্বয় করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস)। এর মধ্যে দাম কমানো হয়েছে ১১ বার, বাড়ানো হয়েছে ১৮ বার।
এদিকে স্বর্ণের দামের পাশাপাশি দীর্ঘদিন এক দরে স্থির থাকার পর চলতি মাসে রুপার দামে রেকর্ড করেছে। দেশের ইতিহাসে রূপার দামও প্রথমবারের মতো সর্বোচ্চ ২১০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চলতি বছর বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়া গত বছর শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রভাবসহ ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির মতো কারণগুলো স্থানীয় বাজারে স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
বছরের শুরুতে গত জানুয়ারিতে ভালো মানের, অর্থাৎ হলমার্ক করা ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ৮৮ হাজার ৪১৩ টাকা। কয়েক দফা দাম বাড়ার পর গত ২১ জুলাই দেশের বাজারে প্রথমবারের মতো প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
আর সর্বশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর স্বর্ণের দাম বেড়ে ১ লাখ ১১ হাজার ৪১ টাকায় পৌঁছায়, যা এখন পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। হিসাবে এই বছর স্বর্ণের দাম বেড়েছে ২২ হাজার ৬২৮ টাকা। বছরের শেষ দিনে নতুন করে দাম না বাড়লে এটাই এখন পর্যন্ত স্বর্ণের সর্বোচ্চ দাম।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, সব থেকে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের ১ হাজার ৭৫০ টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৪১ টাকা। ২১ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম ১ হাজার ৬৯১ টাকা বাড়িয়ে এক লাখ ৬ হাজার ২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এছাড়া ১৮ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম এক হাজার ৬৮ টাকা বাড়িয়ে ৯০ হাজার ৮৭২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর সনাতন পদ্ধতির এক ভরি স্বর্ণের দাম এক হাজার ১৬৬ টাকা বাড়িয়ে ৭৫ হাজার ৬৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে দীর্ঘদিন এক ধরে স্থির থাকার পর চলতি মাসে রুপার দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় জুয়েলার্স সমিতি। প্রতি ভরিতে রুপার দাম সর্বোচ্চ ৩৮৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। তাতে ভালো মানের অর্থাৎ হলমার্ক করা ২২ ক্যারেটের এক ভরি রুপার দাম বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ১০০ টাকা।
এ ছাড়া ২১ ক্যারেট রুপা প্রতি ভরি ২ হাজার ৬ টাকা, ১৮ ক্যারেট রুপা ১ হাজার ৭১৫ টাকা ও সনাতন পদ্ধতির রুপার দাম ১ হাজার ২৮৩ টাকা হয়েছে।
জানা গেছে, স্বর্ণের দাম হু হু করে বাড়তে থাকায় সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে যারা স্বর্ণ অলংকার কেনার কথা ভাবছিলেন, তাদের দুশ্চিন্তা কেবলই বাড়ছে। স্বর্ণ অলংকার দিন দিন তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে স্বর্ণের গয়না বিক্রি কমেছে। তবে ব্যাংকসহ যারা স্বর্ণকে নিরাপদ বিনিয়োগ মনে করে, তাদের কাছে স্বর্ণার চাহিদা বেড়েছে।
এছাড়া দাম বেড়ে যাওয়ায় পুরোনো স্বর্ণের কিংবা অলংকারের সম্পদমূল্যও বেড়েছে। এ কারণে অনেকে বেশি মুনাফার আশায় পুরোনো গয়না বিক্রি করছেন অনেকে।
এবিষয়ে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি এবং বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ডিস্ট্রিক্ট মনিটরিং চেয়ারম্যান ডা. দিলীপ কুমার রায় বলেন, বিশ্ব বাজারে স্বর্ণের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশের জুয়েলারি শিল্প আজকে সংকটে মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
এর প্রধান কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি, ভূরাজনীতি, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, আমদানিতে ভ্যাট, ট্যাক্স বেশি এবং ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ, খনি থেকে স্বর্ণ উত্তোলন কমার পাশাপাশি যারা ধনকুবের তারা নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণে বিনিয়োগ করছে। একই সঙ্গে ধনী রাষ্ট্রগুলো সঞ্চয় হিসেবে স্বর্ণ মজুদ করছে। যার করণে দিন দিন স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি বলেন, বিশ্ব বাজার স্থিতিশীল হলে দাম আবার সহনীয় পর্যায়ে আসতে পারে। নতুন বছরে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। এতো বড় পুঁজি দিয়ে আসলে ব্যবসা করা কঠিন। ইতোমধ্যে অনেক ছোটখাট প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এখন নতুন বছরে নতুন সরকার যদি এই শিল্পের জন্য ভ্যাট ট্যাক্স কিছুটা কমিয়ে দেয়, ভূরাজনীতি শান্ত হয় এবং ধনকুবের দেশ ও ব্যাক্তিরা যদি মজুদের প্রবণতা কমিয়ে দেয় তাহলে ব্যবসা কিছুটা অনুকূলে আসবে।
সিরাজ জুয়েলার্সের মালিক ও বাজুসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহিন বলেন, ডলারের দাম বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি, ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণে চলতি বছর স্বর্ণের দামে বড় ধরনের ওঠানামা ছিল। তবে আমাদের লাভের পরিমাণও কমেছে।
স্বর্ণের দাম বেড়ে যাওয়াতে এখন মানুষ কম ওজনের স্বর্ণও কিনতে চাচ্ছে না। ফলে আমাদের বেচা কেনাও কমেছে। এখন শুধু বিয়েতে ছেলে ও মেয়ে পক্ষ ছাড়া স্বর্ণ তেমন কেউ গিফট দেয় না। তবে নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য বর্তমানে স্বর্ণ ঠিক আছে বলেও জানান তিনি।
শাহিন বলেন, নতুন বছরে আমার প্রত্যাশা থাকবে যুদ্ধ বিগ্রহ যদি থেমে যায় তাহলে দাম কিছুটা সহনীয় পর্যায়ের চলে আসবে। এছাড়া স্বর্ণের দাম ধারাবাহিকভাবে না বেড়ে একটি রেঞ্জ-বাউন্ড বা উচ্চ সীমার মধ্যে ওঠানামা করবে বলে আমি মনে করছি।
জানা গেছে, দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ার মূল কারণ, গত এক বছরে বিশ্ববাজারে মূল্যবান এই ধাতুর দাম বেড়েছে। ২০২০ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স (৩১ দশমিক ১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) স্বর্ণের দাম (স্পট প্রাইজ) ২ হাজার ৭০ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এত দিন ধরে সেটিই ছিল ইতিহাসে স্বর্ণের সর্বোচ্চ দাম। কিন্তু ১ ডিসেম্বর সেই রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায় ওঠে স্বর্ণের দাম, আউন্সপ্রতি স্বর্ণ তখন বিক্রি হয় ২ হাজার ৭২ ডলারে। সর্বশেষ ২৮ ডিসেম্বর স্বর্ণের দাম আউন্সপ্রতি ২ হাজার ৭৫ ডলারের ওপরে উঠে গেছে।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের (ডব্লিউজিসি) হিসাবে, এটিই এখন পর্যন্ত ইতিহাসে স্বর্ণের সর্বোচ্চ স্পট প্রাইজ। স্বর্ণের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা অন্যতম কারণ। গত বছর শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব এ বছরেও কমবেশি ছিল। এর সঙ্গে বছরের শেষ দিক যুক্ত হয়েছে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ।
এছাড়াও ২০২৩ সালে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের চাহিদা বৃদ্ধির পেছনে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতন ও হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ। ভূরাজনৈতিক ঘটনাগুলোর কারণে এ বছর স্বর্ণের দাম ৩ থেকে ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ডব্লিউজিসির আরেক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিশ্বের ২৪ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক মার্কিন ডলারের রিজার্ভ নিয়ে হতাশায় রয়েছে। এ কারণে তারা স্বর্ণের রিজার্ভ বাড়াতে চায়। ২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণের চাহিদা ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আগামী বছরও অব্যাহত থাকবে।
পাশাপাশি ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তাইওয়ান, ভারতসহ বেশ কয়েকটি বড় অর্থনীতির দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। এটিও স্বর্ণের দামে প্রভাব রাখতে পারে।