বায়োটেকনোলজি বা জৈবপ্রযুক্তিকে বলা হয়ে থাকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অন্যতম তুরুপের তাস। উন্নত বিশ্বে জীবপ্রযুক্তিকে ইতোমধ্যে টার্ম কার্ড হিসাবে ব্যবহার শুরু হয়েছে। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র তো এই টার্ম কার্ডকে ব্যবহার করে নানাবিধ সৃষ্ট সমস্যাকে মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক এবং পরিববেশ সূচকে ক্রমবর্ধমান হারে সাফল্য দেখিয়ে চলেছে সাম্প্রতিক সময়ে। বাংলাদেশেও এই টার্ম কার্ড রজত জয়ন্তী অতিক্রম করেছে। সে হিসাবে নতুন অতিথি হিসেবে দেখার সুযোগ নাই জীবপ্রযুক্তিকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে আগামীর বিশ্ব যেই প্রযুক্তিকে গুরুত্ব সহকারে অগ্রাধিকার তালিকায় সবার উপরে স্থান দিয়েছে সেখানে বাংলাদেশে আমরা এখনো পড়ে আছি জাতীয় জীবপ্রযুক্তি নীতি নিয়ে।
বাংলাদেশে বায়োটেকনোলজির প্রসারের প্রধান অন্তরায় সম্পর্কে জানতে এবং বিশ্লেষণ করতে হলে সবার আগে ইতিহাস সম্পর্কে একটু জানা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে বায়োটেকনোলজি নিয়ে গবেষণা শুরু হয় ১৯৭০ এর দশকের শেষ দিকে। পরবর্তীতে বাংলাদেশে বায়োটেকনোলজি বিষয়ে শিক্ষার যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৫ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিএসসি ইন বায়োটেকনোলজি’ প্রোগ্রাম চালুর মধ্য দিয়ে।পরবর্তীকালে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিষয়টি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করলে ২০০৩ সালে ‘বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে প্রোগ্রামটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। যা এখন দেশের প্রায় ৩১ টি সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন নামে পাঠদান করা হয়।
অবশ্য এর অনেক আগেই দেশে জীবপ্রযুক্তি বিষয়ে গবেষণা এবং এর কার্যপরিধি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিলো। ১৯৮৪ সালে সর্বপ্রথম জীবপ্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব সরকারের নিকট পেশ করা হয়। ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে, বাংলাদেশ সরকার বায়োটেকনোলজি প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টের জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ১৯৯৯ সালের ১২ই মে একটি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি’র কার্যক্রম শুরু হয়। বহুমাত্রিক জৈবপ্রযুক্তি গবেষণাকে ত্বরান্বিত করার জন্য, ২০০৬ সালে, সরকার বায়োটেকনোলজি সম্পর্কিত জাতীয় নীতি নির্দেশিকা গ্রহণ করে যা জৈবপ্রযুক্তি সম্পর্কিত জাতীয় টাস্কফোর্স দ্বারা অনুমোদিত হয়েছিল।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মধ্যে রয়েছে ২০১০ সালে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স, ২০১২ সালে ম্যাক্রোফোমিনা ফেজওলিনা ছত্রাকের জিনোম ডিকোড, ২০২১ সালে লবণাক্ততা এবং নিমজ্জন-সহনশীল ধানের সম্পূর্ণ জিনোম ক্রম উন্মোচন। ১৯৭০ এ বাংলাদেশে বায়োটেকনোলজি গবেষণা শুরুর মূল কারণ ছিল কৃষি খাতের তাৎপর্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো বায়োটেকনোলজি শিল্প এখনও জাতীয় অর্থনীতিতে প্রধান অবদানকারী হিসাবে আবির্ভাব ঘটাতে পারেনি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু চলমান গবেষণার ফলাফল এই খাতের যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখায়। কিন্তু সেই সম্ভাবনা চলমান সুযোগ সুবিধার আওতায় কতোটা আলোর মুখ দেখবে তা একটি বড় প্রশ্ন হয়ে ধরা দিয়েছে জীবপ্রযুক্তি বিষয়ক স্নাতকদের মনে।
এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে জাতীয় জীবপ্রযুক্তি নীতি- ২০২৪ এ বাংলাদেশে জীবপ্রযুক্তির সক্ষমতা, সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ে আলোকপাত করা হলেও এবিষয়ে সুস্পষ্ট কোন দিকনির্দেশনা নাই। প্রবল সম্ভাবনাময় একটি বিষয়ের নিগৃহীত শিক্ষার্থীরা গবেষণাগারে না গিয়ে বিসিএস কিংবা সরকারি চাকুরির পিছনে ছুটে চলেছে। সেই ছুটে চলাতেও চরম বৈষম্যের শিকার এসকল গ্রাজুয়েটরা। যেখানে জাতীয় জীবপ্রযুক্তি নীতি- ২০২৪ এ বিসিএস সহ অন্য চাকরীর পরীক্ষায় জীবপ্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষার্থীদের আবেদনের সুযোগের কথা বলা হয়েছে। খাতা কলমে এসকল অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে।
দেশে একবারে যে কাজ হচ্ছে না তা কিন্তু না, কিছু ক্ষেত্রে এই সীমিত সুযোগেও কাজ করে যাচ্ছে কিছু সংস্থা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বিসিএসআইআর স্পিরুলিনা উৎপাদনের উদ্যোগ, বেশ কিছু বেসরকারি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি আলাদা এবং ডেডিকেটেড বায়োটেক ইউনিট গড়ে তুলতে শুরু করেছে। কিছু প্রাইভেট ফার্ম যেমন ব্র্যাক বায়োটেকনোলজি সেন্টার, স্কয়ার এগ্রিক-টেক এবং আমান এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ পর্যাপ্ত পরিমাণে ভাইরাসমুক্ত আলু বীজ উৎপাদন করছে, ধীরে ধীরে আমদানিকৃত আলু বীজের উপর নির্ভরতা কমিয়ে দিচ্ছে। প্রশিকা টিস্যু কালচার সেন্টার এখন বিভিন্ন ধরনের টিস্যু কালচার থেকে উদ্ভূত অর্কিড গাছ রপ্তানি করছে। ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো ইনসুলিন উৎপাদন ও বাজারজাত করতে শুরু করেছে এবং বিদেশে রপ্তানির প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন তৈরির জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান পাওয়ার জন্য ইনসেপ্টা ICGEB-এর সাথে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে। এসকল উদ্যোগ আশানুরূপ সাফল্য পাবে এবং তা দেখে আরো অনেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করবে এমনটাই আশা অবহেলিত হাজারো বায়োটেক গ্রাজুয়েটদের।
আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত বায়োটেকনোলজি ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য নিয়ে এসেছে যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের বায়ো-ইকোনমি বিশ্লেষণ করে। জীবপ্রযুক্তি বিষয়ক ভারতের অর্থনীতিতে ২০১৫ সালে ১০ বিলিয়ন ইউএস ডলার মার্কেট ভ্যালু ছিলো যা মাত্র ৯ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩০ বিলিয়ন ইউএস ডলারে এবং আশা করা যায় আগামী ২০৩০ সালে এটি ৩০০ বিলিয়ন ইউএস ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এজন্যই ভারতে বায়োটেকনোলজিকে ভারতীয় অর্থনীতির মধ্যে একটি সূর্যোদয় সেক্টর হিসাবে অভিহিত করা হয়। এতো এতো সাফল্যের গল্পে আমাদের গল্পটাও কম নয়। কিন্তু সমুদ্রের ধারে নদীর জলের গুরুত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছি আমরা। বিশ্ব দরবারে বায়োটেকনোলজি ২০৩১ সালের মধ্যে ৩.৯০ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলারের মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
আরো একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেখা যাক, প্রতিষ্ঠিত প্রথম ভারতীয় জৈবপ্রযুক্তি সংস্থা ছিল বায়োকন, যেটি ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ডিপার্টমেন্ট অফ বায়োটেকনোলজি যার সফল কর্মপরিকল্পনায় ভারতে আজ বায়োটেকনোলজির জয়জয়কার। আর আমাদের দেশে এনআইবি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালে। যেখানে বেশিরভাগ সময়েই নানাবিধ জটিলতার নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে বায়োটেকনোলজি ক্ষেত্রের বাহিরের গ্রাজুয়েটদের। যেই একমাত্র প্রতিষ্ঠান বায়োটেকনোলজি এর প্রচার এবং প্রসারের জন্য সেখানেই উক্ত বিভাগের শিক্ষার্থীরা উপেক্ষিত। এর মূল কারণটি উদঘাটন করা খুব একটা কঠিন কাজ বলে মনে করেন না বেশিরভাগ বায়োটেকনোলজি গ্রাজুয়েটরা। তারপরেও এর সুষ্ঠু সুরাহা করা সম্ভবপর হয়নি বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। দেশকে চতুর্থ শিল্প বিল্পবে যারা নেতৃত্ব দিবে তাদেরকে নিগৃহীত করে এগিয়ে যাওয়ার মতো দূরদৃষ্টি খুব একটা আশানুরূপ ফল নিয়ে আসবে না। সম্প্রতি এনআইবিতে জাবি বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষককে মহাপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হলেও পদে আসীন হওয়া নিয়ে নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। যা বায়োটেকনোলজি বিভাগের অগ্রসরমান হারকে কমিয়ে দিতে পারে বহুলাংশে। প্রবল সম্ভবনাময় একটি বিষয় কি থমকে দাড়াবে নাকি এই সংকটময় সময় সকলকে একত্রিত করে আলো ছড়াবে তা সময়ই বলে দিবে।
ভারত কি বায়োটেকে গ্লোবাল পাওয়ারহাউস হতে পারে কিনা এবিষয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে, আর আমরা এখনো নীতিমালা প্রণয়ন করে অধিকার আদায়ে ব্যস্ত সময় পার করছি। গবেষণার বিষয়ে সুযোগ সুবিধা রাজপথে আন্দোলন করে আদায়ের বিষয় নয়, এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হওয়া উচিত। আর যদি এভাবেই চলতে থাকে তবে বায়োটেকনোলজির হাজারো গ্রাজুয়েট হয় দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাবে নতুবা ক্ষেত্র পরিবর্তন করে অন্য কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতেই থাকবে। তাতে করে ১৯৪৭ থেকে ২০২৪ কিংবা আরো ৫০ বছর পেরোলেও এদেশ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হাওয়া গায়ে লাগাতে পারবে না। পিছিয়ে থাকা একটা জনগোষ্ঠীর হাজারো মেধাবী গ্রাজুয়েট বিদেশে পাড়ি জমিয়ে জীবপ্রযুক্তি খাতকে সমৃদ্ধ করে তুলছে, আর আমরা শুধু রেমিট্যান্স পেয়েই খুশি। আমাদেরকে স্বপ্ন দেখতে হবে একদিন আমাদের দেশেও জ্ঞান পিপাসু বায়োটেক গ্রাজুয়েটরা আসবে এবং এ দেশ বায়ো ইকোনমি সেক্টরে প্রথম কাতারে থাকবে।
লেখকঃ সাব্বির আহমেদ
প্রভাষক, বায়োটেকনোলজি বিভাগ
জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।