সাব্বির আহমেদ।। ছোটবেলায় গল্প শুনতাম ৭১ এ জ্ঞানী ব্যক্তিদের একে একে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। তাদেরকে নাকি শেষ ইচ্ছে পর্যন্ত জানতে চাওয়া হয়েছিলো না। ভাবতেই গা শিউরে উঠতো যে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে কিভাবে মানুষগুলোকে হত্যা করলো। যেই মানুষগুলো সবসময় স্বপ্ন দেখতেন এবং সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে কাজ করে যেতেন নিরলসভাবে। তাদেরকেই রাতের আঁধারে বরণ করে নিতে হলো মৃত্যু। এ মৃত্যু তাদেরকে অমর করে রেখেছে মানুষের মনে, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন থাকবে তাদের নাম। কিন্তু আসলেই কি আমরা সেই বুদ্ধিজীবীদের আত্মদানকে স্মরণে রাখতে পারছি বা চেষ্টা করছি।
যেসব মানুষেরা নিজেরা বুদ্ধিজীবী ছিলেন তারা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কারণ সকলের মধ্যে একরকম দেশপ্রেম ছিলো, আত্মত্যাগের মহানুভবতা ছিলো। কিন্তু আজ সেই হারানো ইতিহাস গেলো কোথায়!! ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ কি সকল শিক্ষা নিয়ে চলে গেছিলো নাকি আমাদেরকে শিক্ষাবিমুখ করে দিয়ে শিক্ষার গাঁয়ে চাঁদর বিছিয়ে দিয়ে গেছিলো! আসলে এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে খুব ইচ্ছে করে। কারণ তৎকালীন সময়ে সকলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে বিলেত থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশে ফিটে আসতেন সেবার জন্য। আর সেদিন একটা রিপোর্টে দেখলাম বাংলাদেশের বেশিরভাগ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন এখন দেশের বাহিরে গিয়ে থিতু হওয়া। বুদ্ধিদীপ্ত তারকারা সকলে যখন বিলেত গিয়ে বসতি গড়তে ব্যস্ত সেখানে এদেশকে বিলেত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য যারা সেদিন শহীদ হয়েছিলেন তাদের আত্মদানের মূল্য কোথায়! বিষয়গুলো জটিল এবং এবিষয়ে বিস্তর আলোচনার প্রয়োজন। অবশ্য এই মর্মে কথা বলতে গেলে অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে, তাই অন্য প্রসঙ্গে যায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য চক্রান্ত করে। তারা তাদের এ দেশীয় দোসরদের নিয়ে শিক্ষক, বিজ্ঞানী, চিন্তক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, ক্রীড়াবিদ, সরকারি কর্মকর্তাসহ বহু মানুষকে হত্যা করে। ১৯৭১ সালে বছরব্যাপী পাকিস্তান সেনাবাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। পরিকল্পিতভাবে ১৪ ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশীসংখ্যক বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এই দিনকে “শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস” ঘোষণা করেন।
বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এত আয়োজন থাকলেও রাষ্ট্রীয় দিবসের তালিকায় ১৪ ডিসেম্বর না থাকা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশের অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
দেশের স্বাধীনতার ৫৩তম বছর চলছে। এত বছর পরও জাতীয় দিবসের তালিকায় ১৪ ডিসেম্বর না থাকায় অনেকে অবাক হয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রকাশিত রাষ্ট্রীয় তালিকায় এখন ৯১টি জাতীয় দিবসের কথা উল্লেখ আছে। দিবসের গুরুত্ব অনুযায়ী ক, খ ও গ ক্যাটাগরির মর্যাদা ঘোষণা করে সরকার। চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রীয় দিবসের সর্বশেষ তালিকা করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এর মধ্যে ডিসেম্বরে ১১টি জাতীয় দিবস আছে। কিন্তু তালিকায় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস নেই। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকা জাতি যখন আনুষ্ঠানিক বিজয়ের প্রহর গুনছিল, ঠিক তার দুই দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বেছে বেছে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী। তখন থেকেই এ দিনটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় দিবসের তালিকায় এ দিনটি কেন ওঠানো হলো না, সেই প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্ট কারো কাছেই পাওয়া যায়নি। [তথ্যসূত্রঃ দ্য ডেইলি স্টার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৩]
আমরা প্রতিনয়ত বলে থাকি, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রেখে যাওয়া আদর্শ ও পথকে অনুসরণ করে একটি অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে পারলেই তাঁদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে। কিন্তু তাদের সেই আত্মত্যাগের সার্থকতা কি সত্যিই আমরা প্রকৃতপক্ষে দিতে পারছি বা অদূর ভবিষ্যতে পারবো বলে আশা রাখতে পারি!!
কিছু বিষয় দাবি জানিয়ে আদায় করা অসম্মানজনক, এবং তারমধ্যে আমার মতে এই দিবসটিকে অর্ন্তভূক্ত না করাটাও একটা। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে যদি আমরা নিজেরাই সম্মান জানাতে ব্যর্থ্য হয় তবে জাতীয় উন্নয়ন পদে পদে বাধাগ্রস্ত হবে এটা স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়তে হলে জাতির এই সকল শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান জানাতে হবে। নতুবা নতুন প্রজন্মের মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজুল ইসলাম খানের মতো সেইরকম দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী পাওয়ার আশা করাটা বোকামি হবে। বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে আমাদেরকেই নাহলে আজ ৫৩ বছর পরেও কেন আমাদেরকে এসব বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে হচ্ছে। হয়তো তাদেরকে শেষ ইচ্ছে জানতে চাওয়া হলে তারা জানাতেন, আমি এমন শিক্ষিত জনগোষ্ঠী চায় যারা নামের জন্য নয় সুনামের জন্য সদা তৎপর থাকবে। বুদ্ধিজীবি দিবসের চাহিদাপত্রে তাই লিখতে চাই, “এদিন যদি দীর্ঘ হয়, তবে সেদিনের আশা নিরাশার জন্ম দিবে আজন্ম”।
লেখক:
সাব্বির আহমেদ
প্রভাষক, জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।