ব্রিটেনের অন্যতম প্রধান প্রতীক রাজতন্ত্র। ইতিহাসে এক হাজার বছরেরও বেশি সময়ে এই রাজতন্ত্রকে ব্রিটেনের “সফট পাওয়ারের” (অন্যকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা) সবচেয়ে শক্তিশালী উৎস বলেও বিবেচনা করা হয়।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু, তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং নতুন রাজা তৃতীয় চার্লসের ক্ষমতা গ্রহণ যেভাবে বিশ্ব মিডিয়ায় নজর কেড়েছে তাতে ব্রিটেনের রাজতন্ত্রের আকর্ষণ স্পষ্ট দেখা গেছে। রানিকে বিদায় জানাতে আসা জনতার ঢল ব্রিটিশ রানি ও রাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তার অনন্য সাক্ষী হিসেবেই থাকবে।
মার্চের মাঝামাঝিতে ব্রিটেনে ইউগভ নামে জরিপ সংস্থার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, উত্তরদাতাদের মধ্যে ৮১ শতাংশের কাছে রাজশাসকের ভাবমূর্তি ছিল ইতিবাচক। ফলে রানি ও রাজতস্ত্রের এমন জনপ্রিয়তা প্রত্যাশিতই ছিল।
সেকারণেই হাজার বছরের ইতিহাসের জন্য ব্রিটেনকে রাজতন্ত্র ছাড়া কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু সতেরশো শতকে এমনও এক সময় ছিল যখন ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল।
সেটি ছিল রাজা প্রথম ও দ্বিতীয় চার্লসের শাসনের মাঝখানের এক দশক। কাকতালীয়ভাবে, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস এখন রাজা হয়ে তৃতীয় চার্লস নাম গ্রহণ করেছেন।
কিন্তু জানেন কি, সেই সময়ে কী ঘটেছিল?
১৬৪০ এর দশকে ইংল্যান্ডে রাজা প্রথম চার্লস এবং পার্লামেন্টের মধ্যে বিরোধ বাধে , ফলে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ব্লেয়ার ওয়ার্ডেন সেই সময় সম্পর্কে অনেক লিখেছেন এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। তিনি বলছেন, সেই পরিস্থিতিতে তিনটি ভিন্ন সঙ্কট একই সাথে দেখা দিয়েছিল।
একটি ছিল সাংবিধানিক সঙ্কট। রাজা প্রথম চার্লস ফ্রান্স এবং স্পেনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী রাজাদের স্টাইলে শক্তিশালী হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল এমন এক সময়ে যখন তার অবস্থান ছিল খুবই দুর্বল। রাজকার্য চালানোর জন্য তার কাছে পর্যাপ্ত অর্থও ছিল না। অর্থের জন্য তিনি নির্ভর করতেন জমিদারদের আয়ের ওপর। কিন্তু তাদের দেয়া অর্থের পরিমাণ বাড়ছিল না।
অপরদিকে, ইংল্যান্ডে তখন মূল্যস্ফীতিও দ্রুত বাড়ছিল, কারণ আমলাতন্ত্রের কাঠামো বাড়ছিল, ফলে তাদের পেছনেও ব্যয় বাড়ছিল। তহবিল সংগ্রহের জন্য রাজাকে নির্ভর করতে হতো আইনসভার ওপর এবং আইনসভা যখন অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে অস্বীকার করলো তখন সংসদকে পাশ কাটিয়ে রাজা কর বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এর ফলে তৈরি হয়েছিল এক সাংবিধানিক সঙ্কট।
অধ্যাপক ওয়ার্ডেন উল্লেখ করেন, একই সময়ে, স্কটল্যান্ডের ক্যাথলিক গির্জার ওপর অ্যাংলিকান প্রটেস্টান্ট রীতিনীতি চাপিয়ে দেয়ার প্রশ্নে রাজা প্রথম চার্লস জেদ ধরেছিলেন। ফলে দেখা দেয় একটি ধর্মীয় সঙ্কট। স্কটল্যান্ডের অধিবাসীরা এটার বিরুদ্ধে এমন প্রতিরোধ তৈরি করেছিল যে পরে শুরু হয়েছিল তথাকথিত “বিশপদের যুদ্ধ।”
ওয়ার্ডেন জানান, তৃতীয়টি ছিল একটি ব্রিটিশ সঙ্কট। কারণ, ইংল্যান্ডের রাজারা একই সাথে স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডেরও শাসক ছিলেন। ১৭শ শতকের শুরুতে ইংরেজরা আয়ারল্যান্ডে জমির মালিকানা পাচ্ছিলেন। এর ফলে তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজন বিদ্রোহ করতে শুরু করে। ফলে, সব মিলিয়ে ১৬৪০ সালের দিকে এসব রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সঙ্কট ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের মধ্যে সঙ্কটের সাথে যুক্ত হয়।
রাজা প্রথম চার্লসের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের বিজয়ের সাথে সেই গৃহযুদ্ধের সমাপ্তিও ঘটেছিল। কিন্তু পরে যা ঘটেছিল তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না।
যুদ্ধে জয়লাভের জন্য পার্লামেন্টকে একটি সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে হয়েছিল যেটি পরে খুব উগ্র ও বিপ্লবী হয়ে উঠেছিল। সেই বাহিনীর চাপের মুখে ১৬৪৯ সালে রাজাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং রাজতন্ত্র বিলোপ করা হয়। পার্লামেন্টে অভিজাতদের হাউস অফ লর্ডসও বিলুপ্ত হয়। এটিকে ভেঙে ফেলা হয় এবং সদস্যদের নির্মূল করা হয়। ১৬৪২ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন এরকমটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি বলে জানান ইতিহাসবিদ ব্লেয়ার ওয়ার্ডেন।
রাজা প্রথম চার্লসের শিরশ্ছেদের আগেও অন্য একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছিল: রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তার বিচার এবং রায়ে তার মৃত্যুদণ্ড।
এটি ছিল খুবই নতুন এক ধারণা। সাধারণত, মানুষ রাজা বা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করলে রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য তার বিচার করা হয়। কিন্তু তখনকার নেতারা একটি নতুন মতবাদ তৈরি করছিলেন। তা হল, রাজা প্রথম চার্লসই তার প্রজাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।
এই মতবাদটি যাতে উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে অলিভার ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয় পার্লামেন্টে শুদ্ধি অভিযান চালাতে। যেসব সংসদ সদস্য এই বিচার এবং রাজাকে দোষী সাব্যস্ত করার প্রক্রিয়ার সাথে একমত হননি তাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করা হয়েছিল।
সূত্র: বিবিসি