পশ্চিমবঙ্গ সরকার অবশেষে কেলেঙ্কারিতে ঘেরা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলো। রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরেই এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে বড় পদক্ষেপ নিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। গত বুধবার তাকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আনন্দবাজার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বুধবার দুপুরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে গৃহীত হয় এ সিদ্ধান্ত। সর্বসাধারণের অবগতির জন্য বৈঠকের পরপরই এক বিবৃতি জারি করে বলা হয়, এখন থেকে রাজ্যের মন্ত্রিসভায় আর নেই তিনি।
তবে যে বিষয়ে তারা একমত, তা হলো পার্থকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে সাধারণ জনগণের কাছে দুর্নীতিগ্রস্তদের সঙ্গে ‘আপস’ না-করার একটি বার্তা দেয়া গেছে। সে বার্তা জনতা কতটা গ্রহণ করে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। বিশেষত এমন এক সময়ে, যখন বিরোধীরা বহুদিন পর পার্থ-প্রশ্নে রাস্তায় নামতে শুরু করেছে। বুধবার রাজধানী কলকাতা তিনটি মিছিল করেছিল সিপিএম। বৃহস্পতিবার শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিজেপি।
পার্থকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, পার্থের অধীন তিনটি দপ্তরই আপাতত তার হাতে থাকবে। পার্থকে সরানো হয়েছে রাজভবনের অনুমোদন অনুযায়ী। সেই মর্মেই বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে নবান্ন। অর্থাৎ প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা রাজ্যপালকে জানিয়েছেন, পার্থকে আর মন্ত্রিত্বে রাখা হচ্ছে না। তার অধীন তিনটি দপ্তর (শিল্প, পরিষদীয় এবং তথ্যপ্রযুক্তি) মুখ্যমন্ত্রীই দেখবেন।
মুখ্যমন্ত্রীর সুপারিশ মেনে রাজ্যপালের তরফে ওই বিষয়ে সবুজ সঙ্কেত দেয়া হয়। তার পরেই আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি জারি করে নবান্ন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকের দিকে নজর ছিল গোটা রাজ্যের। এসএসসি দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ইডি হেফাজতে থাকা পার্থকে মন্ত্রিসভা থেকে সরানোর বিষয়ে কি সেখানে কোনও আলোচনা করবেন মমতা? কিন্তু ওই বৈঠকে মমতা পার্থকে নিয়ে কোনও কথাই বলেননি। মাত্র ১৫ মিনিটে মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষ হয়ে যায়।
নবান্ন সূত্রের খবর, মন্ত্রিসভার বৈঠকে ওই বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কিছু ছিল না। বৈঠকের আলোচ্যসূচিতেও বিষয়টি ছিল না। কারণ, রাজভবনকে বৃহস্পতিবার সকালেই বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেই মতোই ঘটনাপ্রবাহ এগিয়েছে।
এখন দেখার, দলের তরফে পার্থকে সাসপেন্ড করা হয় কি না। নাকি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে পার্থের মহাসচিব পদ যে যাচ্ছে, তা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে বিশেষ সংশয় নেই।
প্রসঙ্গত, কোনও মন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা (রাজ্য বা কেন্দ্রীয়) থেকে বরখাস্ত করতে গেলে প্রাথমিক ভাবে সংশ্লিষ্ট দলকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে তা মুখ্যমন্ত্রীকে (কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে) জানায়। তখন মুখ্যমন্ত্রী তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে সতীর্থ মন্ত্রীদের সে বিষয়ে অবহিত করেন। তার পরে রাজ্যের ক্ষেত্রে রাজ্যপালের কাছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির কাছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে বরখাস্ত করার জন্য আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠান।
তবে তৃণমূল সব বিষয়েই ‘ব্যতিক্রমী’। পার্থের ক্ষেত্রে দলের তরফে আনুষ্ঠানিক সুপারিশের আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতার তরফে ওই সিদ্ধান্ত এবং সুপারিশ রাজভবনে পাঠিয়েছেন।
গত শুক্রবার (২২ জুলাই) সকালে পার্থর বাড়িতে হানা দিয়েছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। ইডি ওই দিনই অভিযান চালায় একাধিক জেলার আরও ১৪টি জায়গায়। কোথাও কয়েক ঘণ্টা, কোথাও আরও দীর্ঘ ক্ষণ ধরে তল্লাশি-জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। সন্ধ্যার পর আচমকাই শোরগোল পড়ে যায় ‘পার্থ-ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের পর। ইডি সেই ছবি টুইট করে। পরদিন পার্থ এবং অর্পিতাকে এক সূত্রে গেঁথেই গ্রেপ্তার করা হয়। তার ছ’দিন পর পার্থকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরানো হল।
পার্থকে গ্রেপ্তারের দিনেই সাংবাদিক সম্মেলন করে তৃণমূল জানিয়ে দেয়, আদালতে দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবে দল। দু’দিন পর স্বয়ং মমতাও বঙ্গসম্মান অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় প্রায় একই কথা বলেন। মমতা এবং দলের শীর্ষনেতৃত্ব তখন বুঝিয়েছিলেন, ‘আপাতত’ পার্থকে দলীয় পদ বা মন্ত্রিত্ব থেকে সরানো হচ্ছে না।
বিরোধীরা অবশ্য পার্থকে মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কারের দাবিতে সরব হন। এমনকি, তারা মুখ্যমন্ত্রীরও ইস্তফার দাবি তোলেন। তৃণমূলের অন্দরেও পার্থের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি উঠছিল, কিন্তু কেউই এ নিয়ে প্রকাশ্যে নিজেদের মতামত জানাননি বৃহস্পতিবারের আগে পর্যন্ত। ঘটনাচক্রে, বুধবারই ঘটে আর এক প্রস্ত নাটকীয় ইডি অভিযান।
পার্থের গ্রেপ্তারের সময় অ্যারেস্ট মেমোতে মুখ্যমন্ত্রী মমতার নাম এবং ফোন নম্বর দেওয়ায় তার উপর রুষ্ট এবং অসন্তুষ্ট ছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের এক প্রবীণ নেতা তখনই বলেছিলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর নামটা এ ভাবে জড়িয়ে দেওয়ার কাজটা অত্যন্ত অনভিপ্রেত হয়েছে। সেটা করে পার্থ ঠিক করেননি।’
কিন্তু ওই বিষয়ে কোনও অনুতাপ তো দূর, গ্রেপ্তার পার্থ সংবাদমাধ্যমকে সরাসরিই বলেছিলেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে একধিক বার ফোন করেছিলেন। কিন্তু সাড়া পাননি। তৃণমূল সূত্রের খবর, প্রাথমিক ভাবে পার্থের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকলেও ফোনের বিষয়টিতে তার উপর রুষ্ট হন মুখ্যমন্ত্রীও।
ঘটনাচক্রে, বুধবার অর্পিতার বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাটে ইডি হানার আগে সংবাদমাধ্যম পার্থকে মন্ত্রিত্ব ছাড়ার বিষয়ে প্রশ্ন করায় তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কী কারণে?’ সেই বিষয়টিও দলের শীর্ষনেতৃত্ব ভাল ভাবে নেননি।
তাদের মনে হয়েছিল, পার্থ মন্ত্রিত্ব ‘আঁকড়ে’ রাখতে চাইছেন, এবং তা চাইছেন নিজেকে ‘প্রভাবশালী’ বলে প্রতিপন্ন করতেই। পাশাপাশিই, তিনি সংবাদমাধ্যমকে এক বারও বলেননি, তিনি ‘নির্দোষ’। যে প্রসঙ্গ টেনে পার্থের ‘নৈতিকতা’ নিয়েও প্রশ্ন ওঠে তৃণমূল কংগ্রেসের বিভিন্ন পর্যায়ে।
অর্পিতার বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার হয়ে ২৭ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা। সঙ্গে ৪ কোটি টাকারও বেশি সোনা। বেশ কিছু সম্পত্তির দলিল এবং নথিপত্র। বুধবারের এই টাকা উদ্ধারের অভিঘাত আচমকাই অনেকটা বদলে দেয় গোটা পরিস্থিতি। তৃণমূল কংগ্রেসের যেসব নেতা কয়েক দিন আগে পার্থকে পদ থেকে সরানোর ব্যাপারে আদালতের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করার কথা বলেছিলেন, তারাই বুধবার বেলঘরিয়ার ঘটনায় ‘লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে’বলে মন্তব্য করেন। অনেকে বৃহস্পতিবার সকালে পার্থকে বহিষ্কারের দাবি তুলে টুইট করেন।