মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মী নিয়োগে চার লাখ ৭৫ হাজার ৬৭৮টি আবেদন জমা পড়েছে মন্ত্রণালয়ে। দেশটির মানব সম্পদ মন্ত্রী দাতুক সেরি এম. সারাভানান বলেছেন, গত ১ এপ্রিল পর্যন্ত নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে আবেদনগুলো জমা পড়ে।
তিনি জানান, এর মধ্যে উৎপাদন খাতে শ্রমিকদের জন্য মোট দুই লাখ ৯০ হাজার ২৪৮টি আবেদন রয়েছে। আর সেবা খাতে ৭৭ হাজার, বৃক্ষরোপণ ৫৩ হাজার ৮৫৪, নির্মাণ ৪৩ হাজার ৫১৯, কৃষি ১১ হাজার ৩৭, খনি ও কোয়ারি ২০ হাজার।
সারাভানান বলেছেন, আবেদনগুলো বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন অবস্থাতে রয়েছে। মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত উৎপাদন এবং প্ল্যান্টেশন সেক্টরে ২ হাজার ৬০৫ বিদেশি কর্মী নিয়োগের জন্য অনুমোদন দিয়েছে।
সোমবার (৪ এপ্রিল) বিবৃতির মাধ্যমে সারাভানান বলেছেন, অসম্পূর্ণ বা ভুল তথ্য প্রদান এবং কোটা অতিক্রমসহ বিভিন্ন কারণে প্রক্রিয়া করা যায়নি এমন আবেদনও রয়েছে। কর্মসংস্থানের সব সেক্টরে বিদেশি কর্মী নিয়োগের আবেদন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে চলমান রয়েছে।
গত বছরের ১০ ডিসেম্বর সারাভানান বলেছিলেন, দেশে পাঁচটি (বিপজ্জনক, কঠিন) সেক্টরে শ্রমিকের সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। যেমন- বৃক্ষরোপণ, উৎপাদন, উন্নয়ন এবং কৃষি।
এ দিকে গেল বছরের ১৯ ডিসেম্বর সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর চলে গেছে আরও চারটি মাস। কিন্তু মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ। ফলে তিন বছরের বেশি সময় যাবৎ মালয়েশিয়া যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা কর্মীদের হতাশা বাড়ছে।
দুই দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং আন্তর্জাতিক রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ সীমিত সংখ্যক বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্টের (বিআরএ) মাধ্যমে বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়োগ দিতে চায়। তবে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সব বৈধ সংস্থাকে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দিতে চায়। দুই দেশের আলাদা এ নীতির কারণে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনো স্থগিত রয়েছে।
মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়, সব রিক্রুটিং এজেন্সিকে দায়িত্ব দিয়ে ডাম্পিং গ্রাউন্ড করা যাবে না। আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমরা সিন্ডিকেটের পক্ষেও না, বিপক্ষেও না, কর্মী পাঠানোর পক্ষে। একই সঙ্গে মালয়েশিয়ায় বিদেশি চাকরি প্রার্থীদের মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসন নিশ্চিত করতে চায় বাংলাদেশ।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী পাঠাতে গত ১৯ ডিসেম্বর সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে দুই দেশ। এরপর চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি এক চিঠির মাধ্যমে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানান জানান, বাংলাদেশের সব রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্ত করা হবে না। ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে আরও ২৫০টি এজেন্সি সহযোগী হিসেবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে পারবে।
এই প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে ১৮ জানুয়ারি পাল্টা চিঠি দেন বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। যদিও এর এক মাস পর ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে আরেকটি চিঠি দেওয়া হয় মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মানবসম্পদ মন্ত্রীকে। সেই চিঠিতে রিক্রুটিং এজেন্সি সংখ্যা নির্বাচনে স্বয়ংক্রিয় ডিজিটাল পদ্ধতি এবং দুদেশের অনলাইন পদ্ধতি যুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর জন্য একটি যৌথ কারিগরি কমিটির বৈঠক আহ্বান করতে অনুরোধ চিঠিতে জানানো হয়। যদিও এর কোনো আনুষ্ঠানিক জবাব দেয়নি মালয়েশিয়া।
উল্টো ১০ মার্চ মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান প্রকাশ্যে জানিয়ে দিলেন, সব রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্ত করবে না মালয়েশিয়া। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি দেশে কয়েক হাজার এজেন্সি আছে। সবাইকে কর্মী পাঠানোর সুযোগ দিয়ে মালয়েশিয়ায় ডাম্পিং গ্রাউন্ড করতে চাই না। জোর করে শ্রমে বাধ্য করার অভিযোগের বিষয়ে গত ১০ মার্চ দেশটির বিভিন্ন সংস্থা, বিদেশি প্রতিনিধি, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন। এই মতবিনিময়ে নানা বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দেন এম সারাভানান।
তিনি আরও বলেন, এটা নিশ্চিত করতে চাই যে, আমরা শ্রমিকদের জোর করে অতিরিক্ত কাজে বাধ্য করার বিরুদ্ধে লড়াই করছি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আমার সহকর্মীদের প্রতি বিনীত অনুরোধ করছি যে, এজেন্সি দ্বারা সোর্স কান্ট্রিতে কর্মীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এ কারণেই আমি বিদেশি কর্মী আনতে এজেন্সি সীমিত করেছি।
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি দেশে কয়েক হাজার এজেন্সি আছে। আমি সবাইকে কর্মী আনতে দিতে পারি না। আমি এখানে ডাম্পিং গ্রাউন্ড করতে চাই না। এম সারাভানান বলেন, আমি যখন এজেন্সিগুলো সীমিত করেছি, তখন কেউ কেউ বলেন কেন সীমিত করতে হবে? অনেকে বলেন, আপনি কেন নিয়ন্ত্রণ করছেন? আপনি যতক্ষণ আমার স্থানে না আসবেন, ততক্ষণ বিষয়টি বুঝবেন না।
দেশটির মানবসম্পদমন্ত্রী বলেন, আমি সারা বিশ্বে আমার সহকর্মীদের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে আমাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছি। আমরা সঠিক পথেই আছি। আর সোর্স কান্ট্রির কারণে যেন কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং এখানে শিল্প কারখানাতেও যেন কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটা নিশ্চিত করা হবে।
এ দিকে মালয়েশিয়ায় ‘সি’ ক্যাটাগরির অধীনে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ৫০১টি কর্মসংস্থান সংস্থা বিদেশি কর্মী নিয়োগের জন্য আবেদন করার ক্ষেত্রে সেবা প্রদান করতে পারবে। এছাড়া যদি কোনো বেসরকারি কর্মসংস্থান সংস্থা বিদেশি কর্মী নিয়োগের জন্য আবেদনপত্রের এই নিয়মের অপব্যবহার করে তাহলে ০৩-৮৮৮৬ ৫১৯২ এই নম্বরে দেশটির জনশক্তি বিভাগে জানানোর অনুরোধ জানান এম সারাভানান।
গত ২৯ মার্চ মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে কমিউনিটি কর্তৃক আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছেন, অনেকেই নানা বিষয়ে কথা বলেন কিন্তু কর্মীদের বিষয়ে কেউ কথা বলছেন না। সবাই ব্যবসায়িক স্বার্থে কথা বলেছেন।
মন্ত্রী আরও বলেন, আপনারা এখানে অনেকেই বক্তব্য রেখেছেন। শ্রমবাজার ইস্যুতে, এটা হতে দিব না, ওটা হতে দেবেন না, এটা চাই। সবাই এখানে নিজেদের স্বার্থের কথা বলেছেন। ব্যবসায়িক স্বার্থে কথা বলেছেন, কর্মীদের কথা কেউ বললেন না। মন্ত্রী মনে করেন, আমি কিন্তু কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষে না। আমি কেবল কর্মীদের পক্ষে।
তার মতে, তিন বছরের বেশি সময় শ্রমবাজার বন্ধ, কর্মীরা মালয়েশিয়া যেতে পারছেন না। এতে তো কর্মীদের ক্ষতি হচ্ছে। আমরা জানুয়ারিতে চিঠি দিয়েছি, এখন পর্যন্ত পাল্টা জবাব পাইনি। আমাদের জন্য বাজার বন্ধ নেই। এখানকার কারণে বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। কারণ আমাদের শ্রমবাজার খুলতে হবে। একটা সমাধান করতে হবে। আমি এখনো অপেক্ষায় আছি।