ড. আহম্মেদ শরীফ ও নিপা জাহান
১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর জাতীয় সংসদের ৩৭ নং আইনের মাধ্যমে গাজীপুরের বোর্ড বাজারে প্রতিষ্ঠা পায় দেশের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই বিশ^বিদ্যালয় উজ্জীবিত, অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত। বিকেন্দ্রিত ও আইটি-নির্ভর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান নেতৃত্বে রয়েছেন- উপাচার্য প্রফেসর ড. মোঃ মশিউর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলছে।
উচ্চশিক্ষাকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার লক্ষ্যে জাতির আশা আকাক্সক্ষা ও উন্নয়ন ভাবনার সঙ্গে যুক্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থী তালিকাভুক্তি অনুসারে এটি দেশের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। ২,২৫৭টি অধিভুক্ত সরকারি ও বেসরকারি কলেজের মাধ্যমে এর শিক্ষা কর্মসূচি পরিচালিত হয়। ৮৫৭টি কলেজে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৪৫টি কলেজে স্নাতকোত্তর পড়ানো হয়। স্নাতক পর্যায়ে মোট আসন সংখ্যা ৪ লক্ষ ২০ হাজারের অধিক। অধিভুক্ত কলেজগুলোতে বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামে সম্মান ১ম বর্ষ থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত অধ্যয়ন করে ৩৪ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী। ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি ও বেসরকারি কলেজ থেকে প্রায় ৮০ লক্ষ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করেছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব কোর্স চালু রয়েছে- ৪ (চার) বছর মেয়াদি স্নাতক (সম্মান), ৩ (তিন) বছর মেয়াদি স্নাতক (পাস), ৪ (চার) বছর স্নাতক (সম্মান) প্রফেশনাল, ১ (এক) বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য মূল ক্যাম্পাসে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ৫টি অ্যাকাডেমিক কমিটির অধীনে ৩২টি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি- এমএএস/ এডভান্স এমবিএ/এমএসএস; এমফিল এবং পিএইচডি প্রদান করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নপূরণের প্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টিবীজ আহরিত হয়েছে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট থেকে। গোত্র-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ১৯৭১ সালে এই জাতি লাভ করেছে স্বতন্ত্র আত্নপরিচয়, যা এই জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য-ভাষা-সংস্কৃতি বোধ ও অধিকার আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ফল। তাই এই ঐক্যের মেলবন্ধনকে দৃঢ় রাখতে এবং একে সমুন্নত করতে জাতীয় ইতিহাস এবং এর সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ-চর্চার বিকল্প নেই। বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিত্বের নানাদিক, ভাষা-আন্দোলন, বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কীভাবে এই জাতিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আস্থাশীল করেছিল, তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান ও আত্মত্যাগ জাতীয় চার নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের কারণ, সংঘটন প্রভাব-প্রতিক্রিয়ায় সর্বোপরি স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্বাপর নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আগ্রহী। যে চেতনা আত্মত্যাগের মাধ্যমে ব্যক্তিকে মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত¦ প্রতিষ্ঠিত করতে চালিত করে, সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই বিশ্ববিদ্যালয় উজ্জীবিত, অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত। অধিভুক্ত কলেজসমূহের সকল বিভাগের শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক পাঠ্যক্রমের আওতায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ কোর্সের পাঠ প্রদান এবং বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয় আদর্শিক ও নীতিগত অবস্থানকে সুস্পষ্ট করে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের উপর উচ্চতর গবেষণা পরিচালনা, বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ প্রবর্তন ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কলেজ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন, আর্কাইভের দলিল ও নথিপত্র সংগ্রহের জন্য ০৫ অক্টোবর ১৯৯৯ সালে এ ইনস্টিটিউটটি কার্যক্রম শুরু করে। ২০০১ সালে এই ইনস্টিটিউটটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ইনস্টিটিউট তিন শতাধিক এম ফিল লিডিং টু পিএইচডিতে গবেষক ভর্তি করে। পরবর্তীকালে ২০০৪ সালে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে এই ডিগ্রিকে এমফিল সমমানের ডিগ্রি হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় উক্ত ইনস্টিটিউটের জমি ও অবকাঠামো সরকারি নির্দেশনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ-এর অনুক‚লে ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেওয়ায় বর্তমান প্রশাসনের উদ্যোগে ধানমন্ডিস্থ নগর কার্যালয়ের সম্মুখভাগে জমিসহ দ্বিতল ভবন ক্রয় করে এ ইনস্টিটিউটটির কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি বিআইসিসি-তে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সমাবেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য স্থাপনার সঙ্গে এই ইনস্টিটিউট-এর শুভ উদ্বোধন করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষণার মতই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সকল পর্যায়ের (মানবিক, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান) শিক্ষার্থীদের ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ পাঠ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী ও এর সভাপতি প্রফেসর ড. মুনতাসীর মামুন এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদের ভূমিকা অনন্য।
বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর পক্ষ থেকে ৪ জুন ২০১৩ প্রফেসর মুনতাসীর মামুনের নেতৃত্বে জাতীয় সংসদে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির তদানীন্তন সভাপতি রাশেদ খান মেনন, এম.পি-এর নিকট মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকসহ সর্বস্তরে বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাস (১৯৪৭-১৯৯০) অবশ্য পাঠ্য করার দাবীতে স্মারক লিপি প্রদান করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২১ জুলাই ২০১৩ শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করে। সেই সভায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করা হবে বলে জানান।
২০১৪ সাল থেকে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের ইতিহাস’ কোর্সটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে যুক্ত হয়, যা বাংলাদেশে প্রথম। সকল ছাত্রছাত্রীকে এই কোসটি যে পাঠদান করা যায়, সে উদ্দেশ্যে ঐ বছরেই সম্মান প্রথমবর্ষ, সম্মান (চতুর্থবর্ষ) এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একসাথে এই কোর্সটি চালু করা হয়। অর্থাৎ ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২০২২ পর্যন্ত প্রায় ৪০ লক্ষ শিক্ষার্থী/ছাত্রছাত্রী স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের ইতিহাস পাঠ করেছে। দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য পাঠ-পঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে মনজগৎ গড়ে শুরু করেছে। এককথায় ছাত্রদের দেশাত্নবোধ গড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছে।
এছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অ্যাকাডেমিক ভবনে ‘স্বাধীনতার ম্যুরাল’ প্রতিষ্ঠা। হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী বারী ভবনের নাম পরিবর্তন করে পূর্বের নাম ডরমেটরি ভবন করা হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভাষা শহীদদের স্মরণে একটি ‘শহিদ মিনার’ রয়েছে।
বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সত্তর ভাগের বেশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি প্রাপ্ত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক’ লাভ করে। গণমানুষের এই বিশ^বিদ্যালয়ের আজ (২১ অক্টোবর) জন্মদিন। জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় পরিবারের পক্ষ থেকে দেশবাসীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
ড. আহম্মেদ শরীফ ও নিপা জাহান
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলা ৫২ নিউজ/নাহিদ