জাল কাগজপত্র তৈরি করে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর নামে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতকারী চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- চক্রের মূল হোতা আবুল কাশেম শেখ ও তার দুই সহযোগী বখতিয়ার হোসেন এবং মো. নজরুর ইসলাম।
অতি সম্প্রতি তাদের রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। চক্রটি প্রতারণার মাধ্যমে গত ১৫ বছরে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের কাছ থেকে ৫টি মোবাইল ফোন, ১টি ল্যাপটপ, ১টি কম্পিউটার, বিভিন্ন দেশের ৩১টি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। এছাড়াও প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ১৩টি ইমেইল অ্যাকাউন্ট ও ১টি ওয়েবসাইট চিহ্নিত করা হয়েছে। উদ্ধার পাসপোর্টগুলো আমেরিকা, জার্মান, জাপান, ইতালি, দুবাই, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে মানব পাচার ও প্রতারণায় ব্যবহার করার জন্য নিজের কাছে রাখতেন আবুল কাশেম বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ডিবি পুলিশ জানায়, মানব পাচার চক্রটির মূল পরিকল্পনাকারী আবুল কাশেম শেখ ভারত থেকে ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিকেশন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং তিনি ইংরেজিতে কথা বলা এবং লেখায় পারদর্শী। তার কথিত এনজিও প্রতিষ্ঠান ‘কথক একাডেমী’র নামে মিথ্যা তথ্য উপাত্ত যুক্ত করে ইমেইল পাঠিয়ে বিভিন্ন আন্তজার্তিক কনফারেন্সে যোগদানের জন্য ইউএন সদরদপ্তরের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করে অফার লেটার চাইতেন। চিঠি পাওয়ার পর আমেরিকান এম্বাসিতে পাসপোর্টসহ সকল প্রকার কাগজপত্র জমা দিয়ে ভিসার জন্য আবেদন করতেন। ওই নাম সর্বস্ব এনজিও’র কোন রেজিস্ট্রেশন নেই। তবে আবুল কাশেমের দাবি, তার পরিচালিত ‘কথক একাডেমী’ ইউএন ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিলের (ইকোসক) স্পেশাল কনসাল্টেটিভ স্ট্যাটাসপ্রাপ্ত।
পুলিশ বলছে, প্রতারণামূলকভাবে ইউএন সদরদপ্তর থেকে অফার লেটার সংগ্রহ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানব পাচার করাই আবুল কাশেমের মূল উদ্দেশ্য।
আবুল কাশেম সোর্সদের মাধ্যমে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে কথক একাডেমীর ষ্টাফ বলে ডকুমেন্ট তৈরি করে ইউএন ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিলের (ইকোসক) বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য প্রথমে ইউএন সদরদপ্তরের কাছে রেজিষ্ট্রেশন করে। ইকোসকের বিভিন্ন কনফারেন্সে যোগদানের জন্য অনুমতি চেয়ে ইউএন সদরদপ্তরে ‘কথক একাডেমী’ নামক নাম সর্বস্ব এনজিও’র উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচয়ে ইমেইল পাঠাতেন। পরে ইউএন সদরদপ্তর অনুমতি দিলে অনুমোদনের চিঠিসহ আমেরিকান এম্বাসিতে পাসপোর্টসহ সকল প্রকার প্রার্থীদের কাগজপত্র জমা দেন। এম্বাসি প্রার্থীদের ইন্টারভিউ ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে ভিসা (সি২/অফিসিয়াল/মাল্টিপল ভিসা ৩ মাস মেয়াদী) প্রদান করে। ভিসা পাওয়ার পর আমেরিকায় গিয়ে মেয়াদ শেষে বিভিন্ন অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে ওই দেশেই থেকে যান ভুক্তভোগীরা। এ চক্রের প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীর সংখ্যা প্রায় ৮০ জন।
গ্রেপ্তার আবুল কাশেম নিজেকে প্রতারণামূলকভাবে তার এনজিও’র উপদেষ্টা হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব সুলতান মাহমুদের নাম পরিচয় এবং তার স্বাক্ষর জাল করে আমেরিকান এম্বাসিতে চিঠি পাঠিয়ে ভিসার জন্য আবেদন করতেন। আর তার প্রতারণার কাজে সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন বখতিয়ার ও নজরুল ইসলাম।
ডিবি সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ জানায়, এর আগে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগদানের কথা বলে ইউএন সদরদপ্তরে ভুয়া তথ্য যুক্ত ইমেইল পাঠিয়ে প্রতারণামূলকভাবে আমেরিকান ভিসা সংগ্রহকারী চক্রের ৪ জনকে আমেরিকান এম্বাসি কর্তৃপক্ষের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। ওই মামলার তদন্তকালে চক্রের মূল পরিকল্পানারীসহ তিনজনকে সনাক্তের পর গ্রেপ্তার করে ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) ডিভিশনের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম।
পুলিশ বলছে, আবুল কাশেম নিজেকে এনজিও ‘কথক একাডেমী’র সিও পরিচয়ে প্রতারণা ও মানব পাচার করেন। তার সহযোগী বখতিয়ার বেকার ও নজরুল একটি বেসরকারী হাসপাতালের সহকারি ম্যানেজার (মার্কেটিং) হিসেবে কর্মরত। চক্রটি ২০০৮ সাল থেকে এভাবে প্রতারণা করে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। গ্রেপ্তার আবুল কাশেমের নামে রাজধানীর ভাটারা, শাহবাগ ও পল্লবী থানায় প্রতারণাসহ পাসপোর্ট আইনে মামলা রয়েছে।
ডিবি সাইবারের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. জুনায়েদ আলম সরকার জানান, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানের কথা বলে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ভুয়া তথ্যযুক্ত ইমেইল পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা সংগ্রহের আবেদন করা হচ্ছে, মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধির এমন অভিযোগে রাজধানীর গুলশান থানায় একটি মামলা হয়। এ ঘটনায় ডিবি সাইবার বিভাগের সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং টিম এই প্রতারণা চক্রের ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। পরে তদন্তভার ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমকে দেয়া হয়। টিমটি তদন্ত করে গত ৩ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে রাজধানী ও আশপাশের এলাকা থেকে আবুল কাশেম, বখতিয়ার ও নজরুলকে গ্রেপ্তার করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, গ্রেপ্তার আবুল কাশেম শেখ একটি আন্তর্জাতিক মানব পাচার ও প্রতারক চক্রের মূল হোতা। তিনি জাতিসংঘসহ কবে কোথায় সম্মেলন হচ্ছে সেগুলোর নিয়মিত খোঁজ রাখতেন এবং ওই সব সম্মেলনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ মাত্রই তিনি কথক একাডেমীর বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিচয়ে কনফারেন্সে যোগদানের জন্য জাতিসংঘ সদর দপ্তরের কাছে ইমেইল পাঠাতেন।
কথক একাডেমির আড়ালে ১০-১২ লাখ টাকার বিনিময়ে ২০১২ সাল থেকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান, ইতালি, দুবাই, ফ্রান্সসহ উন্নত দেশগুলোতে মানব পাচার করেন। প্রতারক আবুল কাশেম তার এনিজিওর উপদেষ্টা হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব সুলতান মাহমুদের পরিচয় ও তার স্বাক্ষর জাল করে বাংলাদেশে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে চিঠি পাঠিয়ে ভিসার জন্য আবেদন করতেন। গ্রেপ্তারকৃতদের এ ধরনের প্রতারণামূলক কাজের ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতি হচ্ছে। যে সকল ব্যক্তি প্রকৃত কারণে মার্কিন ভিসার প্রাপ্তির জন্য আবেদন করেন, তারা নানাভাবে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন।
এ ধরনের প্রতারণা এড়াতে গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ কিছু পরামর্শ দিয়েছে।
সেগুলো হলো-
পাসপোর্টে জাল ভিসা কিংবা জাল সিল ব্যবহার করা বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে অপরাধ। এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকা।
বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করাটা-মার্কিন ভিসা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করে না।
মার্কিন ভিসা প্রাপ্তির লক্ষ্যে সব সময় সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা। তথ্য মিথ্যা প্রমাণিত হলে তা গুরুতর অযোগ্যতা বলে বিবেচিত হয়।
অজান্তে এ ধরনের প্রতারণার শিকার হলে অতিদ্রুত পুলিশকে জানানো।