সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে দ্বৈরথ এবং দ্বন্দ্ব, তার রঙ্গমঞ্চ হয়ে উঠেছে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকা। বিশেষ করে বিশ্বের একক সুপারপাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল।
দেশটি এতোদিন মধ্যপ্রাচ্য এবং আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ধীরে ধীরে তারা নজর সরিয়ে এনেছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে।
ইউক্রেনে যুদ্ধ সত্ত্বেও এটা বলা যায়, আমেরিকার ভবিষ্যত ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনায় ইন্দো-প্যাসিফিক হচ্ছে প্রধান অংশ।
কিন্তু এই অঞ্চলের প্রতি আমেরিকার এতো আগ্রহের কারণ কী?
বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির ভরকেন্দ্র
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে দেশ আছে এক ডজনেরও বেশি। আছে চীন, ভারত, পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। আছে জাপান-কোরিয়ার মতো অর্থনৈতিক শক্তি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে যে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি ঘোষণা করে, সেখানে তারা দেখিয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক দেশগুলোতে যে জনসংখা সেটা বৈশ্বিক জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি, যার ৫৮ শতাংশই আবার তরুণ। কর্মশক্তি এবং ভোক্তা -দুই হিসেবেই সংখাটা বিশাল।
এখানকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক অর্থনীতিরই দুই-তৃতীয়াংশ, জিডিপি’র পরিমাণ হচ্ছে বৈশ্বিক জিডিপি’র ৬০ শতাংশ।
এছাড়া বিশ্বে যে সমুদ্র আছে, তার ৬৫ শতাংশ পড়েছে ইন্দো-প্যাসিফিকে, ভূমির ক্ষেত্রে যেটা ২৫ শতাংশ। সবমিলিয়ে এই অঞ্চল হয়ে উঠছে বৈশ্বিক রাজনীতির ভরকেন্দ্র এবং আগ্রহের কারণ।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি’র অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এই অঞ্চলের দেশগুলো গত একদশকে ব্যাপকভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে। আপনি যদি ২০৪০ সালের হিসেব করেন, তাহলে দেখবেন তখন সারা বিশ্বের জিডিপি’র ৪৫ শতাংশের বেশি এই অঞ্চলে থাকবে। দ্বিতীয় যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে, এই এলাকা দিয়েই মূলত: বৈশ্বিক জ্বালানীর একটা বড় অংশের সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।
তবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ মনে করেন, এ এলাকায় মার্কিন আগ্রহের প্রধান কারণ হচ্ছে নিরাপত্তা। “যদি এই অঞ্চলে চীনের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে এখানকার সমুদ্রকেন্দ্রিক বাণিজ্যের উপর চীনের একধরণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।”
আমেরিকার টার্গেট কি চীন?
আমেরিকা যে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি বা আইপিএস ঘোষণা করেছে, সেখানে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, ফিলিপাইন, বাংলাদেশসহ এখানকার দেশগুলোকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক, নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিকের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই কৌশলে চীনকে অন্তর্ভূক্ত হয়নি। বরং চীনকে ঐ অঞ্চলে প্রতিবেশীদের প্রতি আগ্রাসী এবং ক্ষতিকর হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, চীন তার সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত শক্তির সমন্বয়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে চীন প্রচলিত বিশ্বব্যবস্থা এবং নিয়ম-নীতিরও লংঘন করছে।
যদিও চীন পাল্টা অভিযোগ করছে, আইপিএসে’র মাধ্যমে মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা জোট আসলে সামরিকভাবে চীনকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। আর চীন আন্তর্জাতিক জলসীমায় জাহাজ চলাচলে বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু আইপিএসে’র মাধ্যমে আমেরিকা’র টার্গেট কি আসলেই চীন?
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলছেন, আমেরিকা তার আইপিএস উদ্যোগে চীনকে রাখেনি। কারণ এখানে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা চীনের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র আইপিএসে বলছে ‘রুল বেইজড’ বিশ্ব ব্যবস্থার কথা, যেটার নেতৃত্বে আছে যুক্তরাষ্ট্র। চীন বলছে, এই ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে। কারণ এটা তৈরি হয়েছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। তখন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের যে অপরিমেয় ক্ষমতা ছিলো তারা সেভাবেই বৈশ্বিক রুল ঠিক করেছে। চীন সেই রুল মানতে চায় না, এটা বদলাতে চায়। এখানেই মূল দ্বন্দ্ব।
ইন্দো-প্যাসিফিকে চীন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আমেরিকা সেখানে পিছিয়ে পড়বে। আর এর প্রভাব পড়বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য এবং আধিপত্যের উপর। তাই আমেরিকা সেখানে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
কিন্তু এখানে জাপান-ভারতের মতো দেশগুলোর স্বার্থ কোথায়? “চীনের সঙ্গে জাপানের বিরোধ আছে, দক্ষিণ কোরিয়ারও বিরোধ আছে। ভারতের সঙ্গেও সীমান্ত নিয়ে সংঘাত আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক রুকসানা কিবরিয়া বলেন, চীনের যে উত্থান তাতে আমেরিকা, জাপান সবাই চিন্তা করছে যে, চীনের সামরিক বাহিনী এখন ভারত মহাসগরেও নজরদারি করতে সক্ষম।
“ফলে অতীতে যেটা হয়নি সেটাই হচ্ছে। আমেরিকা এমনকি ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী করতে অস্ত্র দিচ্ছে,” বলেন রুকসানা কিবরিয়া।
তবে ভারতকে অস্ত্র সহায়তার পাশাপাশি আরেকটি কাজ করছে আমেরিকা। সেটা হচ্ছে, কোয়াড নামে সামরিক জোটকে সক্রিয় রাখা। এই জোটে আছে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া।
ইন্দো-প্যাসিফিকে আমেরিকার যেমন আগ্রহ আছে, তেমনি ভারত-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়াসহ আসিয়ানভুক্ত কোন কোন দেশেরও আছে নিজস্ব স্বার্থ।
আর এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়েই এখানকার দেশগুলোকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে অভিন্ন নিরাপত্তা কৌশল তৈরি করতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
তবে শেষপর্যন্ত এই এলাকায় চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব কোনদিকে গড়ায় তার উপরই নির্ভর করছে অনেককিছু।
সূত্র: বিবিসি বাংলা