মো:আলরাজী: অনিয়মতান্ত্রিক ব্যয়, অনুমোদনবিহীন ক্রয় ও প্রকল্প চালু, অবৈধ বার্ষিক সাধারণ সভা, আর্থিক জালিয়াতি ও সাধারণ সদস্যদের সঙ্গে প্রতারণা ও বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে চেতনা বহুমুখী সমবায় সমিতির পরিচালনা কমিটির বিরুদ্ধে। বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ সমবায় অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রার ও মহাপরিচালক বরাবর জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সাধারণ সদস্যরা। বিষয়গুলো তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সাধারণ সদস্যদের সব অধিকার নিশ্চিতের জন্য অধিদপ্তরের হস্তক্ষেপ চান তারা।
জানা গেছে, ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত চেতনা সমিতির বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৫ হাজার ২৬ জন। রাজধানীর মিরপুরের মনিপুরের চেতনা কুটিরে এর অফিস। সমিতির মোট মূলধন প্রায় ৬৪ কোটি টাকা। তার মধ্যে মালিক পক্ষ বা পরিচালক ৯১ জনের মূলধন এক কোটি ৬৬ লাখ টাকা। অবশিষ্ট পলিসি সদস্যদের মূলধন প্রায় ৬২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
বর্তমান সমবায় আইন অনুযায়ী সব সদস্যই সমিতির মূল সদস্য এবং সবার অধিকার সমান। আইন অনুযায়ী সদস্যদের মধ্যে কোনো প্রকারভেদ না থাকলেও চেতনা সমিতির সদস্যদের ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে। সমিতির মাত্র ৯১ জন পরিচালক সভ্য ঋণ গ্রহণ করলে সমিতিকে বার্ষিক ১২ থেকে ১৮ শতাংশ লাভ প্রদান করতে হয়। কিন্তু অবশিষ্ট ৫ হাজার সদস্যের কাছ থেকে ঋণের লাভ গ্রহণ করা হয় বার্ষিক ৩৬ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঋণের লাভ গ্রহণের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ প্রমাণ করে সমিতি কর্তৃপক্ষ সমবায় আইন অনুযায়ী ৫ হাজার ব্যক্তিকে সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না।
যে কোনো সাধারণ সভায় উপস্থিতির জন্য সব সদস্যকে নোটিশ প্রদান এবং কোরাম সংখ্যক সদস্যের উপস্থিতিতে সভা করার নিয়ম রয়েছে। অথচ ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই ও গত বছরের ২৩ মার্চ দুটি বার্ষিক সাধারণ সভায় এ নিয়ম প্রতিপালন করা হয়নি। এসব সভায় সদস্যদের স্বার্থবহির্ভূত অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে পীরেরবাগে নির্মাণাধীন চেতনা টাওয়ারের বাণিজ্যিক তিনটি ফ্লোর ৮২ জন সদস্যের নামে নামমাত্র মূল্যে বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
এতে বঞ্চিত হয়েছেন মূল সদস্যরা, যারা ভবনের জন্য ক্রয়কৃত জমির মূল্য ও নির্মাণ ব্যয় বাবদ মোট ১২ কোটি ৩০ লাখ টাকার সম্পূর্ণ মূলধন সরবরাহকারী। একইভাবে চলতি বছরের ৮ মার্চ ৩২তম সাধারণ সভায়ও সাধারণ সদস্যদের উপস্থিতি ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।সমিতির ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৩২তম বার্ষিক সাধারণ সভা বইয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটি কর্তৃক উপস্থাপিত হিসাবে প্রকৃত ব্যয় গোপন করা হয়েছে। সেখানে পাঁচটি খাতে খরচ হওয়া ৭ কোটি ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ৯০১ টাকা লাভ-ক্ষতি হিসাবে কৌশলে অন্তর্ভুক্ত না করে বিলম্বিত হিসাবে দেখানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে মেয়াদি আমানত লাভ বা সদস্য সঞ্চয় আমানত লাভ, সদস্য সঞ্চয় পলিসি লাভ, মাঠকর্মী ভাতা, পুরস্কার ও উপহার এবং বৈঠকি ভাতা।
উপরোক্ত টাকা যদি বিলম্বিত হিসাবে না দেখানো হতো তাহলে সমিতির প্রকৃত ক্ষতি দাঁড়ায় ৬ কোটি ৯৯ লাখ ১৬ হাজার ৯৬৮ টাকা। কিন্তু সাত কোটি টাকার বেশি বিলম্বিত দেখিয়ে উল্টো লাভ দেখানো হয়েছে ১৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৬৩ টাকা। একাধিক সাধারণ সদস্য অভিযোগ করে বলেছেন, বাস্তবে সমিতি যে ক্ষতির মধ্যে আছে তাতে সদস্যদের পুরস্কার ও উপহার বাবদ এবং বৈঠকি ভাতা দেওয়ার কোনো সুযোগ বা সক্ষমতা নেই। সে জন্যই প্রকৃত ক্ষতি না দেখিয়ে ব্যয় বিলম্বিত করে দেখানো হয়েছে।
সমবায় আইন অনুযায়ী ৫ লাখ টাকার উপরে যে কোনো ক্রয় বা ব্যয়ের ক্ষেত্রে সমবায় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পূর্বে অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মিরপুর ৬০ ফিট পীরেরবাগে ৬ কোটি টাকায় ছয় দশমিক ৪২ কাঠা জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কমিটি সমবায় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়নি। ছয় কোটি টাকার অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প গ্রহণেও নেওয়া হয়নি অনুমোদন। একইভাবে অনিয়মের মাধ্যমে ‘চেতনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ নামে কোম্পানির সঙ্গে সংশ্নিষ্ট হয়ে সমিতির সম্পত্তি আত্মসাতের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ২০ কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি থাকলেও কাগজে-কলমে ভুয়া লাভ দেখিয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা নিয়মিত মাসিক কার্যভাতা গ্রহণের লক্ষ্যে ১৫ লাখ ৪৮ হাজার টাকার বাজেট পাস করিয়ে তা গ্রহণ করেছেন। একইভাবে নেওয়া হচ্ছে প্রকল্প ভাতাও। সমবায় আইন অনুযায়ী কমিটির কার্যভাতা গ্রহণের সুযোগ না থাকলেও এরকম অস্বাভাবিক ভাতা গ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে সমিতির সভাপতি সুলতানা সিদ্দিককে ফোন করা হলে তিনি কথা না বলে সম্পাদক ইকবাল হোসেনকে ফোনে ধরিয়ে দেন। ইকবাল হোসেন বাংলা 52 নিউজকে বলেন, বিলম্বিত ব্যয় দেখানোর নিয়ম আছে বলেই এভাবে ব্যয় দেখানো হয়েছে। অনুমোদন ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে তিনি বলেন, সব প্রকল্প ও আয়-ব্যয়ের বিষয়ে জেলা সমবায় কর্মকর্তা অবহিত আছেন।চেতনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিষয়ে সমিতির সম্পাদক বলেন, প্রথমে সমিতির নামে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শেয়ার কেনা হয়েছিল। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নই হয়নি। এ-সংক্রান্ত সব কাজগপত্র রয়েছে। সমিতির সব সদস্যকে নিয়ম অনুযায়ী সাধারণ সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। নিয়ম অনুযায়ী তারা ঋণ প্রদান করেন। এক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য করা হয় না।
ঢাকা জেলা সমবায় কর্মকর্তা মোল্লা মো. নিয়ামুল বাসার বলেন, সব সদস্যকে লভ্যাংশ দেওয়া হয় না বলে শুনেছি। তবে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে কোনো লিখিত দরখাস্ত পাইনি। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।