রাজশাহী প্রতিনিধি : আরএমপির বোয়ালিয়া মডেল থানার দোতলার একটা বড় ঘরের মেঝেতে গাদাগাদি করে বসে আছে শতাধিক কিশোর-তরুণ। তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। সাংবাদিকরা যাতে ছবি তুলতে না পারে সেজন্য মায়েরা ওড়না দিয়ে ছেলেদের মুখ ঢেকে রেখেছেন। কেউ কেউ একটু পরপর ওড়না দিয়ে প্রিয় সন্তানের চোখের পানি মুছছেন। সামনে চেয়ার-টেবিলে বসে থানার ওসিসহ বোয়ালিয়া থানার কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। তারা কিশোরদের উদ্দেশ্যে মোটিভেশনাল বক্তব্য দিচ্ছেন। কিশোররা ঘাড় নেড়ে সায় দিচ্ছেন কর্মকর্তাদের কথায়।
ঈদের আগের তিনদিনে এমন শতাধিক কিশোর তরুণকে কিশোর গ্যাং সদস্য হিসাবে নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তুলে বোয়ালিয়া মডেল থানায় আনেন রাজশাহী মহানগর পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট। জড়ো করা হয় বোয়ালিয়া মডেল থানার দোতলার একটি বড় ঘরে। পুলিশের ফোন পেয়ে ওই তিনদিনে রাতভর অভিভাবকরা থানায় গিয়ে মুচলেকা দিয়ে নিজ নিজ সন্তানকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। থানা থেকে বিদায়ের সময় পুলিশ সদস্যরা তাদের একটা করে রজনীগন্ধার স্টিক হাতে ধরিয়ে দেন। পুলিশের তথ্যমতে, অনেক অভিজাত পরিবারের সন্তানরাও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হয়ে এই তিনদিনে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। কেউ ব্যস্ত শহরে টিকটক করছিল। কেউবা মোটরসাইকেল দৌড় প্রতিযোগিতা করছিল। আবার অনেকেই মোড়ে বসে আড্ডা মারছিল। মহানগরীর কিশোর গ্যাং সদস্যদের উৎপাত সামলাতে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছেন।
কিশোর তরুণদের বেপরোয়া গতির মোটরসাইকেল দৌড়ের লাগাম টানতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপও নিচ্ছেন। কিন্তু এরই মধ্যে ৩ জুলাই রাতে নগরীর হেতেমখা এলাকায় কিশোর সানিকে কুপিয়ে হত্যা করে আরেকদল কিশোর। একদিন পর ৫ জুলাই রাতে নগরীর বেলদারপাড়ায় খুন হন আরেক কিশোর সোহেল রানা। এরপর থেকে নগরীতে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা থামাতে পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে রাতের নগরীতে সড়কে বের হলেই এখন পুলিশের সচকিত টহল সহজেই চোখে পড়ে। গভীর রাতে পুলিশ কমিশনার নিজেই নগরীতে বেরিয়ে পড়ছেন। ঘুরে ঘুরে দেখছেন নগরীর পরিস্থিতি। কোথাও অসঙ্গতি দেখলে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে নির্দেশ দিচ্ছেন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে।
রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, রাজশাহী প্রকৃতপক্ষে একটি শিক্ষানগরী। দ্রুত বর্ধনশীল এ নগরীতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এসে বাড়িঘর করে বসবাস করছেন। সম্প্রতি গ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। তবে শিল্পায়ন না ঘটায় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়নি। বিনোদন ক্রীড়ার আয়োজনেও ঘাটতি আছে। কিশোর তরুণরা পদ্মার পাড় থেকে শুরু করে নগরীর অলিগলির মোড়ের আড্ডাকেই বিনোদন ভেবে সেখানে অধিক সংখ্যায় জড়ো হয়। অনেকেই মাদকেও আসক্ত হচ্ছে। পুলিশ মোড়ে মোড়ে নজরদারি বাড়িয়েছে। কোনো কিশোর তরুণ শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজে জড়ালে ক্ষেত্রবিশেষে থানায় এনে অভিভাবকদের হাতে তুলে দিচ্ছি। এদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে সতর্ক থাকতে হয়।
৮ জুলাই বিকালে রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানায় আনা হয় বেশ কয়েকজন কিশোর গ্যাং সদস্যকে। ওই রাতে থানায় দেখা যায়, বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম কিশোরদের উদ্দেশ্যে কিছু বলছেন। যেমন চুল এভাবে কাটা যাবে না। সুন্দর করে চুল কাটতে হবে। শরীরে এসব ট্যাটু-ম্যাটু রাখা যাবে না। এসব দেখলে আবার ধরে আনা হবে। তখন আর ছাড়া হবে না। সোজা কোর্টে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কিশোররা মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছিলেন। একজন অভিভাবক বললেন, আমি সরকারি চাকরি করি। রাতে বাসায় ফিরি। ছেলে পড়ার নাম করে কোথায় যায় কী করে এসব খবর পাই না। কখন যে খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মিশে নষ্ট হতে বসেছে বুঝতেই পারিনি। ওসি মাজহার বলেন, এখন থেকে টিকটক বন্ধ। কেউ টিকটক করবে না। এখানে-ওখানে দলবেঁধে বসে থাকা যাবে না। ইভটিজিং করা যাবে না। কেউ ইভটিজিং করলে আমরা ছাড়ব না। কিশোর-তরুণরা একসঙ্গে উত্তর দিল-‘না’। আমরা আর এসব করব না। ওসি বললেন, এখন অভিভাবকরা মুচলেকা দিয়ে সবাইকে নিয়ে যাবেন। পরে দশজন কিশোরকে অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ ধরনের কার্যক্রম চলবে। এভাবে কিশোর-তরুণদের বাগে আনার চেষ্টা চলছে।
৩ জুলাই একদল কিশোর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের সামনে থেকে সানি নামের এক কিশোরকে তুলে নিয়ে গিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। সানি জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম পাখির ছেলে। এবার এসএসসি পরীক্ষা দিত সে। আড়াই মাস আগে বিয়েও করেছিল। এ হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে।
জানা গেছে, কিশোর সানি হত্যা মামলার ৯ আসামির মধ্যে পাঁচজনই কিশোর। পাঁচজনই গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতার কিশোররা পুলিশকে জানিয়েছে, কিশোর গ্যাং দ্বন্দ্বের জেরেই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তারা সানিকে খুন করে। সানির গ্যাং তাদের গ্যাংয়ের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। তাই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, নিহত কিশোর সানির নামেও থানায় বিভিন্ন অপরাধে মামলা রয়েছে। খুন হওয়ার কয়েকদিন আগে তাকে ধরে এনে অভিভাবকের জিম্মায় দেওয়া হয়েছিল।