জুলফিকার আলী,কলারোয়া(সাতক্ষীরা)প্রতিনিধিঃ কুমির একটি নিরীহ প্রাণী।
শান্তিতে থাকতে-ই ভালোবাসে। এই প্রাণীকে নিয়ে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই।
তাকে বিরক্ত না করলে সে কারোর কোন ক্ষতি করে না। আর গল্পের ছলে কথাগুলো
বলছিলেন-সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার ছালিমপুর গ্রামের বাসিন্দা ও
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ব্যবসায়ী রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের
ব্যবস্থাপনা পরিচালক কুমির বিশেষজ্ঞ এনাম হক। তিনি কুমির বিশেষজ্ঞ হিসেবে
অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, আফ্রিকা মহাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন
দেশে পরামর্শক হিসেবে দীর্ঘ কয়েক দশক অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন।
অস্ট্রেলিয়াতে বাণিজ্যিকভাবে কুমির উৎপাদনে জড়িত তিনি। বাংলাদেশে কুমির
চাষের সম্ভাবনা বিশ্ববাজারে কুমিরের চামড়া, হাড়, দাঁত এবং মাংস বিক্রি
হয়ে থাকে। ইউরোপ, আমেরিকা, ফান্স, জার্মানী সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর
ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। একটি কুমিরের চামড়া ৫০০-৬০০ ডলারে বিক্রি করা হয়ে
থাকে। রাতারাতি এই ব্যবসায় উত্থান সম্ভব নয়। এখানে রয়েছে বিপুল পুঁজির
বিনিয়োগ, কিন্তু আয়ে ধীরগতি। ২০১৫ সালে জার্মানে ৬৯টি কুমিরের চামড়া
বিক্রি করা হয়। বাংলাদেশ থেকে সর্বপ্রথম ভালুকার রেপটাইল ফার্ম লি. থেকে
এই কুমিরের চালানটি রপ্তানি করা হয়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫০৭টি কুমিরের
চামড়া রপ্তানি করা হয়েছে। বছরে ১হাজার কুমিরের চামড়া রপ্তানির
লক্ষ্যমাত্রা ধরে কাজ করছে খামার কর্তৃপক্ষ। দেড় যুগের ব্যবধানে বিশ্ব
বাজারে জায়গা করেছে বাংলাদেশের কুমিরের চামড়া। ২০২২ সালের মার্চে খামারের
সার্বিক অবস্থা ছিলো প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত। কুমিরের অবস্থা বিবেচনায় যেমন
কথাটি প্রযোজ্য ছিল, তেমনি খামারের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও অবকাঠামোর
ক্ষেত্রে একই অবস্থা বিরাজ করছিল। পিকে হালদারের ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে
প্রায় বন্ধ হওয়া রেপটাইল ফার্ম লিমিটেড রক্ষা করতে হাইকোর্ট থেকে একটি
পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে। এই পর্ষদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে
নিয়োগ দেয়া হয়েছে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও কুমির বিশেষজ্ঞ
এনাম হক এর। এই পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব গ্রহণের সময় কুমিরের সংখ্যা ছিল
১৭৩০টি। এর ভেতর ৩৫০টি কুমির ছিল অসুস্থ ও মুমূর্ষ। গড়ে প্রায় ৫-৬টি
কুমির প্রতিদিন মারা যাচ্ছিল। এর প্রধান কারণ ছিলো সঠিক পরিচর্যা,
পর্যাপ্ত খাবারের অভাব। ক্ষুধার যন্ত্রণায় দেয়ালে এবং মাটিতে মাথা আঁছড়ে
নিজেরাই নিজেদের মুখ ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে অসহায় কুমিরগুলো। খামারের
সমস্ত এলাকাজুড়ে ছিলো ময়লা অবর্জনা এবং জঞ্জালে পূর্ণ। অবকাঠামোগুলো ছিলো
অরক্ষিত। বিভিন্ন অংশে দেয়ালে ফাটল ও শ্যাওলা দিয়ে আচ্ছাদিত। অর্থনৈতিক
অব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাবে খামারে কর্মরত তাদের দায়িত্ব পালন করতে
ব্যর্থ হচ্ছিল। প্রায় প্রত্যেকটি মানুষের স্বপ্ন থাকে, কিন্তু স্বপ্নের
পথে পা বাড়ালেই একের পর এক আসতে থাকে প্রতিবন্ধকতা। যে ব্যক্তি এসব
প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এগিয়ে যাবেন তিনিই হবেন সফল। যিনি অনেক বাধা ও
প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে একজন সফল ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছেন।
এক্ষেত্রে গ্রামের ছেলে এ বাক্যটির বাস্তব উদাহারণ যেন অস্ট্রেলিয়া
প্রবাসী এনাম হক। প্রবাসী হয়েছেন দীর্ঘ কয়েক দশক আগে। প্রবাসে থেকে দেশে
স্কুল কলেজ, মাদরাসা এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন
হতদরিদ্র, প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, গরীর মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের
প্রতিনিয়ত সাহায্য করে থাকেন এই প্রবাসী এনাম হক। খামারটির দ্বায়িত্ব
নিয়েই তিনি ৮০০ কুমিরের বাচ্চা জন্মদানের ব্যবস্থা করেন। এখনে পূর্বের
অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বহির্বিশ্বে রপ্তানির প্রক্রিয়া আরো চালু
করছেন। সঙ্গে সঙ্গে এই খামারটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে এই খামারটিতে পর্যটনের সুযোগ। একজন
দেশপ্রেমিক, প্রকৃতি প্রেমিক, রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা
পরিচালক এনাম হক। কুমির চাষ খুবই লাভজনক। তবে এর জন্য প্রয়োজন বড়
বিনিয়োগ ও সঠিক পরিকল্পনা। চাষের জন্য খনন করা পুকুরগুলোর তলদেশ পাকা এবং
চারপাশে তিন ফুট ইটের ওপর তিন ফুট কাঁটাতারের বেষ্টনি করে কুমির ছাড়তে হয়
। ভালুকায় রেপটাইল ফার্ম ঘিরে প্রাকৃতিক পরিবেশে কুমির পালন ও বেড়ে ওঠা
নিশ্চিত করার জন্য ৪০ প্রজাতির ছয় হাজার ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগান
লাগানো হয়েছে। কুমিরগুলোকে খাবার হিসেবে দেয়া হয় মাছ ও মাংস।
প্রাপ্তবয়স্ক কুমিরকে সপ্তাহে একদিন খাবার দেওয়া হয়। এনাম হক আরো
জানান-কুমিরের গড় আয়ু ১০০ বছর। ডিম নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম। দেশে
বাণিজ্যিকভাবে খামার করে লাভবান হতে পারেন অনেকেই। বিশ্বজুড়ে পর্যটন
শিল্প একটি অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হিসেবে সুপরিচিত। পর্যটন
শিল্প বর্তমান বিশ্বের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে
বিবেচিত হয়ে আসছে। পর্যটন শিল্পে বিশ্বের বুকে এক অপার সম্ভাবনার নাম
বাংলাদেশ। এ দেশের প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য পৃথিবীর অন্য দেশ থেকে অনন্য ও
একক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। পর্যটন বিকাশে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা।
পর্যটন উৎকর্ষ সাধনের পর্যাপ্ত সুযোগ যেমন আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে
রয়েছে, তেমনি রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। ভালুকায় রেপটাইল ফার্ম এদিক
থেকে তৈরি করেছে অনন্য একটি সুযোগ। এই খামারটি তখনই লাভবান হবে যখন এর
সাথে পর্যটন যুক্ত হবে বলে মনে করেন কুমির সংশ্লিষ্টরা।