আবুল কালাম আজাদ (রাজশাহী):-রেলওয়ের লেভেল ক্রসিংয়ের প্রকৃত মালিক কে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে ধোঁয়াশা। লেভেল ক্রসিংয়ে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। ঝরছে তাজা প্রাণ। এ বিষয়ে রেল কর্তৃপক্ষেরও তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দায়সারা কথা বলছেন। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, আমরা বারবার বাধা দেওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সংস্থা তাদের মতো করে লেভেল ক্রসিং তৈরি করছে। এখানে কোনো রকম আমাদের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করছে না।
ফলে ওইসব লেভেল ক্রসিংয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, রেলওয়ের লেভেল ক্রসিং তুমি কার? রেল সূত্র জানায়, অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের প্রায় ৫০ ভাগই তৈরি করেছে এলজিইডি, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ। রেলওয়ের মোট ২ হাজার ৯৫৫ দশমিক ৫৩ কিমি রুট রয়েছে। এর মধ্যে সারা দেশে রেলওয়ের লেভেল ক্রসিং রয়েছে ২ হাজার ৭৮৯টি। রেলওয়ের অনুমোদিত লেভেল ক্রসিং ১ হাজার ৪৬৮টি। অনুমোদন ছাড়া লেভেল ক্রসিং রয়েছে ১ হাজার ৩২১টি।
অনুমোদন ছাড়া লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) পূর্বাঞ্চলে ২৩৭টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৫৮টি। এলজিইডির অর্থায়নে ইউনিয়ন পরিষদের নির্মিত পূর্বাঞ্চলে ২৯৮টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ২০৪টি। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) পূর্বাঞ্চলে ৫টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ৭টি। সিটি করপোরেশনের পূর্বাঞ্চলে ২২টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ৩২টি। উপজেলা পরিষদের পূর্বাঞ্চলে ৭টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ২টি। পৌরসভার পূর্বাঞ্চলে ৫৭টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ৫৯টি। এ ছাড়া অবৈধ রয়েছে পূর্বাঞ্চলে ১০৯টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ৬১টি। রেলের অনুমোদিত লেভেল ক্রসিং ১ হাজার ৪৬৮টির মধ্যে মাত্র ১ হাজার ৫৯০ জন গেটম্যান অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছেন।
ফলে শিফটিং ডিউটি করার কোনো সুযোগ নেই। আর অনুমোদন ছাড়া লেভেল ক্রসিং কে বা কারা চালাচ্ছে সেটি কেউ জানে না। রেলের একটি সৃত্র বলছে,অবৈধ নয়, শুধু বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোরই যথাযথ নির্মাণ রক্ষণাবেক্ষণ করতে ন্যূনতম ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন। বৈধ ক্রসিংগুলোয় হাতে চালিত লোহার বার ফেলা হয়। এসব বারের বেশিরভাগই ভাঙা, ওঠাতে-নামাতে সময় লেগে যায়। এ সুযোগে অনেক যান ভেতরে প্রবেশ করে। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পেলে গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিংগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালনা করা সম্ভব। এসব অবৈধ ও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ শতাধিক মামলা করেছে। যেগুলো এখন বিচারাধীন। কোনো কোনো মামলা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কারণে মাঝপথে ঝুলে আছে।
ফলে লেভেল ক্রসিংগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলোতে রেল কর্তৃপক্ষ সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড টানিয়েছে। রেলের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ১৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৪৫ জনেরই মৃত্যু হয়েছে রেলগেটে সংঘটিত দুর্ঘটনায়। তাদের প্রায় সবাই ক্রসিং পার হতে যাওয়া বাস, মাইক্রোবাস ও ছোট যানবাহনের আরোহী। এর বাইরে একই সময়ে সিগন্যাল অমান্যের জন্য দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪০টি; যেগুলোতে মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের। সবচেয়ে বেশি ঘটেছে লাইনচ্যুতির ঘটনা। সাত বছরে ৮৫৬টি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। সব মিলিয়ে এ সময়ে ট্রেন দুর্ঘটনায় ১৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলীদের সাফকথা সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে যেসব রেলওয়ের লেভেল ক্রসিং রয়েছে, তার একটিও তাদেল তত্ত্বাবধানে নেই। এগুলোর সবই রেল কর্তৃপক্ষ দেখে।
ফলে লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার দায় তাদের নয়। রেল কর্তৃপক্ষ নিজেদের দোষ আড়াল করতে আমাদের দিকে অভিযোগের তীর ছুড়ে লাভ নেই। কারণ লেভেল ক্রসিংয়ে অনেক সময় সমস্যা থাকে, সেগুলো আমরা ঠিক করে দিই, যাতে দুর্ঘটনা কম হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মধ্যে যেসব লেভেল ক্রসিং রয়েছে, সেগুলোর দেখভালের দায়িত্ব রেল কর্তৃপক্ষের। এখানে তাদের গেটম্যান দেওয়ার কথা। কিন্তু তারা যদি গেটম্যান না দেয়, সেখানে আমাদের কী করার আছে। তথ্যানুযায়ী ,রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান প্রকৌশলীর অধীনে পিডব্লিউআই (পার্মানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টর), এপিডব্লিউআই (অ্যাসিস্ট্যান্ট পার্মানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টর), মিস্ত্রি ও চাবিম্যানসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছেন। প্রতিটি ট্রেন ছাড়ার ১০ মিনিট আগে রেলপথ চেকআপ করার কথা থাকলেও সেটা করা হয় না।
তাই দিন দিন ট্রেন দুর্ঘটনা বাড়ছে। পিডব্লিউআই সপ্তাহে এক দিন এবং এপিডব্লিউআই সপ্তাহে তিন দিন এলাকাভিত্তিক রেলপথ পরিদর্শন করার কথা। কিন্তু সারা বছরে একবারও তাদের দেখা মেলে না। অন্যদিকে মিস্ত্রির প্রতিদিন লাইন চেক করার এবং চাবিম্যানের প্রতিদিন লাইনের চাবি, ওয়াসার নাটবল্ট চেক করার কথা থাকলেও তারা এ বিষয়ে একেবারেই উদাসীন। পশ্চিম রেলের প্রধান প্রকৌশলী মোঃ মনিরুজ্জামান ফিরোজী বলেন, অবৈধ রেলওয়ে লেভেল ক্রসিং নিয়ে আমরাও বিপাকে রয়েছি। এলজিইডি, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগকে নিয়ে বিভিন্ন সভায় আলোচনা করেছি এভাবে অবৈধ লেভেল ক্রসিং না করার জন্য। কারণ এতে দুর্ঘটনা বাড়ছে।
আর এসব সংস্থা লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করলেও লেভেল ঠিক রাখে না। পারাপার হওয়ার সময় রেলগেটের ওপর গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে। এটি হওয়ার কারণ সড়কের ওপর দিয়ে যাওয়া রেললাইনের বাড়তি উচ্চতা। লেভেল ক্রসিং মানে রেললাইনের সঙ্গে সমতা থাকতে হবে। কিন্তু সংস্থাগুলো সেটি করে না। এতে গাড়ি উঠতে সমস্যা হয়। বাড়ছে দুর্ঘটনা। আমরা ৩০০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচলের কথা ভাবছি। কিন্তু অবৈধ রেলওয়ে লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে সেটি পারছি না। অন্যদিকে রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতাও রয়েছে। ফলে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যান না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে ট্রেন। সঙ্গত কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে রেল সম্পদের। রেলপথের যেকোনো স্থানে অনুমোদন না নিয়েই লেভেল ক্রসিং বানায় স্থানীয় বাসিন্দারা। আর এতে অনেক সময় স্থানীয় জন
Enter
Abul
প্রতিনিধিদের সায় রয়েছে। এ নিয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের। যার কারণে সব লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যান দেওয়া সম্ভব হয়নি। পশ্চিম রেলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন,যেসব লেভেল ক্রসিং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নির্মাণ করেছে, সেগুলো দেখভাল আমরা করছি। কিন্তু অর্ধেকই নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডি, সিটি করপোরেশন ও পৌর কর্তৃপক্ষ। এগুলো বেআইনি। রেললাইনকে কখনও ক্রস করা যায় না। এটি হয় আন্ডারপাস, না হয় ওভারপাস দিয়ে যেতে হবে। এর বাইরে গেলে সেটি রেললাইনের সঙ্গে সমতা রেখে যেতে হবে। কারণ রেল তার মতো চলে যাবে। তাই এগুলো যারা তৈরি করেছে, দেখার দায়িত্ব তাদেরই। তিনি আরো বলেন, কেউ আইন অমান্য করলে সেটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আমরা বিভিন্ন সভায় যেসব সংস্থা এই লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করে, তাদের অনুরোধ করেছি। এ ছাড়া লেভেল ক্রসিং দিয়ে চলাচল যানবাহনগুলোও আইন মেনে চালানো হয় না। গেট বন্ধ থাকলেও ঢুকে পড়ে। এতে য়তো দুর্ঘটনা ঘটবেই। এ জন্য সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে। তারপরও আমরা মানবিক কারণে দেখছি। কিন্তু সব দেখতে পারি না।